বাউল, গান, Baul, Song, Gaan, সূফী, বৈষ্ণব ,শাক্ত

বাউল গানের সন্ধানে


In Search of Baul Song


লক্ষ্মী পাল।



Home » Medinikatha Journal » Lakshmi Pal » বাউল গানের সন্ধানে



মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধর্মমতের উন্মেষ এবং কমবেশি এগিয়ে চলা। বঙ্গদেশেও রয়েছে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, বাউল, বৈষ্ণব, সূফী, শাক্ত প্রভৃতি নানাবিধ ধর্ম সম্প্রদায়। সেইসাথে এই দেশের লোকসংস্কৃতিতে মিশেছে বিবিধ ধর্মকেন্দ্রিক গানের প্রবহমান ধারা। এই বহমান প্রবাহের মধ্যেই নিহিত রয়েছে অসাধারণ জীবনদর্শন, অপূর্ব তত্ত্ব এবং সাধনপদ্ধতি যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সার্বিকভাবে জানা এবং অনুভব করে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। উপরন্তু এদের আছে মন্ত্রগুপ্তি।


’’আপন ভজন কথা না কহিবে যথাতথা

আপনাতে আপনি হইবে সাবধান।‘’


কিন্তু বাউল, সূফী, বৈষ্ণব ,শাক্তরা শুষ্ককাষ্ঠবৎ নীরস সাধকমাত্র নয়। মানবমনের গহনে বিচরণকারী ও পরমসত্যের জন্য সন্ধানরত মানুষগুলির গান গাওয়াতেই মনের মুক্তি, ভাবের প্রকাশ।মদন বাউলের অভিব্যক্তিতে মেলে তারই সমর্থন -


’’যদিও করছ মানা ওগো বন্ধু মানি এমন সাধ্য নাই।

আমার নামাজ আমার পূজা গানে গানে চলছে তাই।‘’


অনেক সময় শব্দ- ছন্দ- সুরের মেলবন্ধনে সাধক তার চাওয়া- পাওয়া- উপলব্ধি প্রভৃতি ব্যক্ত করেন অনায়াস দক্ষতার দ্বারা। আপনভাবে বিভোর হয়ে এরা যখন প্রকাশ করেন ‘অচিন পাখি’, ‘মনের মানুষ’, ‘অরূপ রতন’ ‘গুরু’ ইত্যাদির কথা তখন চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা জগত থেকে সংগ্রহ করে নেন সদৃশ উপকরণ যেগুলি রূপক- উপমা- উৎপ্রেক্ষাদি হয়ে সৃষ্টি করে তোলে রসনিবিড় নান্দনিকতা। সেইসাথে ব্যঞ্জিত হয় মিষ্টিসিজিমও। উপরন্তু গানগুলিতে থাকে আকর্ষণীয় ছন্দের দোলা এবং ভাবাবেগের মনোগ্রাহী প্রকাশ। এসবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাউল ও সুফীগানের সর্বজনীন হয়ে ওঠার মূলসূত্র যা জনপ্রিয়তার কারণ এবং আলোচনার প্রেক্ষাপট। এই সূত্রই শ্রোতা বা পাঠক মনে জাগ্রত করে বাউল- ফকি র- সূফী প্রভৃতি লোকায়ত সাধনা ও সঙ্গীত সম্বন্ধে কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা, ভালোলাগা আর সেইসাথে সমৃদ্ধ হতে থাকে লোকসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি।


বাউল, গান, Baul, Song, Gaan, সূফী, বৈষ্ণব ,শাক্ত
বাউল গানের সন্ধানে | In Search of Baul Song

বাউল গানের সৃষ্টির সময় এবং মূলস্রষ্টার সন্ধান করতে যাওয়া তরঙ্গসংকুল অকূল পাথারে নিমজ্জিত প্রায় মানুষের হাবুডুবু খেতে খেতে কূলে পৌঁছানোর প্রচেষ্টার সমতুল্য। বাউলদের গানগুলির কেন্দ্রস্থ বিষয় এক হ’লেও অঞ্চলভেদে উচ্চারণের সুর ভিন্ন ভিন্ন। সেইজন্য উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে বাউলগানের বিশেষ উৎস- অঞ্চল নির্ধারণ করা সহজসাধ্য নয়। উপরন্তু আদিপর্বের গানগুলি গীত হ’তে শোনা যেত অক্ষরজ্ঞানহীন গায়কের কণ্ঠে। সম্ভবত সেইজন্য ঐ পর্বের গানের লিখিতরূপও দুষ্প্রাপ্য। এইসব কারণে আলোচ্য বিষয়ের শুরুর সময় সম্বন্ধে বিভিন্নজন বিবিধ মত প্রকাশ করেছেন। আবুল আহসান চৌধুরী মনে করেন প্রাচীনতম বাউলের নাম ‘আদিনাথ’। শোনা যায়, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতে বাউলদের আদিগুরু ‘চৈতন্যদেব’। ডঃ ব্রতীশ ঘোষ ‘প্রসঙ্গঃবাউল গান’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘বাউল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল প্রাক চৈতন্য যুগে মালাধর বসুর লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যটিতে। আবার ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের অন্ত্যখন্ডে গ্রন্থরচয়িতা কৃষ্ণদাস কবিরাজও ‘বাউল’ কথাটি একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। এই প্রসঙ্গে ডঃ ঘোষ লিখেছেন, ‘’শ্রী চৈতন্যই এই সাংকেতিক বার্তার বাউল।‘’


‘’ বাউলকে কহিও লোক হইল বাউল।

বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।

বাউলকে কহিও কামে নাহিক আউল।

বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।‘’


অপরদিকে কিছু বাউলের মতে, তাদের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সহজ নিত্য মানবসত্যের উপরে। সুতরাং ‘যতকাল মানব ততকাল এই সহজ বাউলিয়া মত।‘ তাই অনেকে বলেন, বাউলিয়া সহজমত অনাদিকালের। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ‘বাউল’ শব্দটি ‘প্রেমপাগল’ বুঝাতেও ব্যবহার করা হয় এবং সেখানে কোনও ধর্ম বা জাতপাতের ভেদাভেদ নেই। ডাঃ ঘোষ জানিয়েছেন, বাংলার মুসলমান বাউলরা তাঁদের গানে কবীর, নানক, দাদু, রামদাস প্রমুখের নাম উল্লেখের সাথে সাথে হজরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া, হজরত শয়খউদ্দীন গঞ্জ- ই- শকর প্রভৃতি সুফী- দরবেশদের নামও করেছেন।


অসাম্প্রদায়িক বাউল সাধক চিরকাল ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরমসত্ত্বাকে। কবীরের গানেও ব্যক্ত হয়েছিল সেই কাম্যকে পাওয়ার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা-


‘’নৈহরসে জিয়ারা ফাটরে

নৈহর নগরী জিসকৈ বিগড়ী

উসকা ক্যা ঘর বাটরে।

তনিক জিয়রবা মোর ন লাগৈ,

তন মন বহু উচাটরে।।‘’


(‘আমার স্বামীর ঘরের জন্য আমার প্রাণ ব্যাকুল। স্বামীর ঘর যার কাছে প্রসন্ন হয় নি, তার ঘরই বা কি পথই বা কি। ওগো, আমার কিছুতেই আর বিন্দুমাত্র মন লাগে না। আমার তনু মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে আছে।‘)


প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের মধ্য থেকে উৎসারিত এবং বর্তমানেও প্রচলিত এই তত্ত্বনিষ্ঠ, সাধনালব্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রবহমান ধারাকে সন- তারিখ দিয়ে নির্দিষ্ট করে তুলবার ক্ষেত্রে কমবেশি মতপার্থক্য থাকলেও কিছু গবেষকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাউলগান জনসমক্ষে এসে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একাধিক গবেষক বাউল সাধনার তত্ত্ব, অভীষ্টে পৌঁছানোর স্তরাদি বিশ্লেষণও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম লালন ফকিরের কিছু গান সংগ্রহ করে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। বাউলগানের সংগ্রহকারী হিসেবে মুহম্মদ মনসুরুদ্দীনের নামও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসা বাউলগানের অনেকগুলি তিনি উদ্ধার করে ‘হারামণি’ নাম দিয়ে তিনটি খণ্ডে প্রকাশ করে লোক সংস্কৃতির সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম লালন ফকিরের গান সংগ্রহ করলেও মুহম্মদ মনসুরুদ্দীন পরে লালনের অনেক গানসহ ঈশান, দুদ্দুশাই, আশবর, পাগলা কানাই, কালাচাঁদ প্রভৃতি বহুজনের রচনা উদ্ধার করে ‘হারামণি’-তে যুক্ত করেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘প্রবাসী’, ’মর্মবাণী”, ‘মানসী’- তে সংকলিত হয়েছিল কেরামত আলি খাঁ, দুই খুরা, গঙ্গারাম বাউল, শাহই লাল, মনোমোহন প্রমুখের বাউল সংগীত।


বাউল, গান, Baul, Song, Gaan, সূফী, বৈষ্ণব ,শাক্ত
বাউল গানের সন্ধানে | In Search of Baul Song

মোহঃ আশরফ হোসেন সাহিত্যরত্ন কাব্যবিনোদ ১৩৩২ সাল থেকে ১৩৩৯ সাল পর্যন্ত যেসব লোকগান সংগ্রহ করেছিলেন তারমধ্যে বাউল, পোলক, মিঠান প্রভৃতিও আছে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে লেখা যে একচল্লিশটি বাউল গান পাওয়া যায় সেগুলিই সংকলিত গ্রন্থ ‘রাগ বাউল’। ডঃ আহমদ শরীফের ‘বাউলতত্ত্ব’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থটি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হলে সেটিও অসাধারণ কাজ হিসেবে মান্যতা অর্জন করেছিল। এটিতে বহু প্রতিভাধর বাউলের কথা আছে যারা লালন শাহের অসামান্য গুণাবলি ও খ্যাতির কারণে জনগণের দৃষ্টির বাইরে থেকে গিয়েছিলেন বলে যথাযথ সময়ে মান্যতা অর্জন করতে পারেন নি। ১৯৬৮ খৃস্টাব্দে ঢাকা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল লালন শাহের পূর্ণাঙ্গ গানের সংকলন। এই অসামান্য সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন মুহম্মদ আবু তালিব। ১৯৭১ সালে বোরহানুদ্দীন খান জাহাঙ্গীর দ্বারা সম্পাদিত ‘বাউল গান ও দুদ্দুশাহ’ নামক সংকলন গ্রন্থটিও ঢাকা একাডেমি থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটিতে দুদ্দুশাহের ৩১৪টি অমূল্য বাউল গান আছে। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও বাউল সম্পর্কে অনেক অসাধারণ কাজ করেছেন। এখনো কিছু গবেষক এই জনপ্রিয় গানের ধারাটি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন।



বাউল গান এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমবেশি স্থান অর্জন করে নিয়েছে। বৃহত্তর জগতে এই গান সম্পর্কে যে আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা এবং জনপ্রিয়তা লক্ষিত হয় তার প্রারম্ভিক কাজটি কিন্তু শুরু করেছিলেন কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, সরলা দেবী, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী ও আরও কয়েকজন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম আর অবদান অবশ্য স্মরণীয়। বাংলা লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বাউলচর্চা প্রথম শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। আগেই জানিয়েছি, তিনি লালনগীতি সংগ্রহ করেন এবং সেই গীত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে বা নৌকায় থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন বাউল, এমন কি গগন হরকরার সাথে পরিচিত হন। মনে করা হয়, ঐ সময় থেকেই তার মনে বাউল গানের বিশেষ প্রভাব পড়ে। বিশ্বকবি নিজেই বলেছেন ’’…বাউল পদাবলীর প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানে আমি বাউল সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোনো এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।‘’ উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে একটি বাউল গানের কথা যেটির রচয়িতা ও গায়ক ছিলেন বাউল সাধক লালন ফকিরের শিষ্য গগন হরকরা।


‘’আমি কোথায় পাব তারে ,আমার মনের মানুষ যে রে-

হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে, দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।।

লাগি সেই হৃদয় শশী , সদা প্রাণ হয় উদাসী, পেলে মন হত খুশী ,

দিবানিশি দেখিতাম নয়ন ভরে।…..”


গানটি শুনে কবি যে গানটি লিখেছিলেন সেটি আজও জনপ্রিয় এবং বাংলা দেশের জাতীয় সংগীত।


‘’আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।‘’

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, মরি হায়, হায় রে -

ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।। ….’’


এই প্রসঙ্গে অর্ঘ্য চৌধুরীর মন্তব্য স্মরণীয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘’এই গান শুনে কবির চেতনা ও অনুভূতি অনন্য সুষমায় ভ’রে উঠেছিল। তিনি পল্লীবধূর চোখে দেখেছিলেন অঘ্রানের ভরা ক্ষেত, নবান্নের সমারোহ আর স্নেহমায়াময় চাহনি। দেখেছিলেন মাটির ঘরের নিকনো আঙিনায় গৃহলক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। এই গৃহলক্ষ্মীই কবির ‘’বাঙলা-মা’’। ‘’অন্যদিকে ১৯০৫ সালে যখন ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে দেশ উত্তাল তখন কবি তাঁর অনেক স্বদেশী গানে প্রাণছোঁয়া বাউল গানের সুর ব্যবহার করে যুব-সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এগুলি ব্যতীতও বিশ্বকবির অসাধারণ প্রতিভার সাথে বাউল গানের বিবিধ প্রভাব যুক্ত হয়ে বেশকিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষ মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ১৯২৫ খৃস্টাব্দের ২৮ই সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে ভারতীয় দর্শন মহাসভার অধিবেশনে সভার সভাপতি হিসেবে কবি যে ‘philosophy of our people’ শিরোনামের অভিভাষণটি পাঠ করেছিলেন তার প্রায় সব তত্ত্ব ও বাণী সংগৃহীত হয়েছিল নিরক্ষর বাউলদের কাছ থেকে। ১৯৩০ খৃস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্বজ্জন সমাবেশে আমন্ত্রিত হন Hibbert বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। সেখানেও তিনি উচ্চমার্গের দর্শন অথবা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নয়, বক্তব্য রেখেছিলেন ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অক্ষরজ্ঞানহীন, দীন, সহজ পথের সহজ মানুষ সন্ত - বাউলদের মানবধর্ম অর্থাৎ ‘Religion of Man’ সম্পর্কে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য শ্রীক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী ১৯৪৯ খৃস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লীলা বক্তৃতামালা’র জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘’বাংলাদেশের সাধনার কথা বলিতে গেলে বাংলাদেশের বাউলদের কথা বলিতেই হইবে। বাউল সধকেরা বাংলাদেশের মর্মের কথা বলিয়াছেন।‘’ এই ভাষণে বক্তা প্রধানত বর্ণপরিচয়হীন সাধকদের সাধনার বিষয়েই আলোচনা করেছিলেন।


বাউল তত্ত্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে আত্মাকে চেনার মধ্য দিয়ে পরমাত্মাকে জানা এবং পাওয়ার কথা। বাউলদের বিশ্বাস মানুষের দেহের মধ্যেই রয়েছে তাদের কাম্য বিশ্ব আর সব চাওয়া- পাওয়া। সেইজন্য শাস্ত্র এবং লোকাচার বাউলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এদের ধর্মকে ‘মানবধর্ম’ আর এদের ‘সহজ সাধক’ বলা যেতেই পারে। আত্মনুসন্ধানরত সাধক উপলব্ধি করে এক অদৃশ্য , অধরা সত্তাকে । সাধকরা বলেন,



‘’আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে

জনম ভরে একদিনও দেখলাম না তারে।‘’


বাউল গান রচয়িতারা ‘মনের মানুষ’, ’রসের মানুষ’, ‘গুরু’, ‘অচিন পাখি’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁদের আরাধ্যকে উল্লেখ করবার জন্য। সেই অধরাকে জানবার জন্য, তার কাছে পৌঁছাবার জন্য যে ব্যাকুলতা তা বাউলরা প্রকাশ করেছেন কথা ও সুরের মেলবন্ধন দ্বারা। যেমন,


‘’খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়

তারে ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম তাহার পায়।‘’


শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরা রচিত একটি গান শুনেছিলেন যেটিতে ব্যঞ্জিত হয়েছে তীব্র ভাবাবেগ , আরাধ্যকে পাওয়ার অসীম আকুতি।


‘’আমি কোথায় পাব তাঁরে

আমার মনের মানুষ যে রে।

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।‘’


বিশ্বকবির জীবনদেবতার সাথে বাউলের মনের মানুষের কোথায় যেন সাদৃশ্য আছে। তিনি উপনিষদের ‘অন্তরতর যদ্যমাত্ম’-কে বাউলের ‘মনের মানুষ’ বলে উপলব্ধি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘Religion of Man’-এ লিখেছিলেন, ’’Where shall I meet him-the man of my heart. He is lost to me. Seek him wondering from land to land.’’ বাউলদের ধর্মীয় ভাবনায় প্রেমের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। দুই যখন এক হয়ে যায় তখনই হয় যথার্থ প্রেমের উদয়। ‘নিত্য- দ্বৈতে নিত্য- ঐক্য প্রেম তার নাম। ‘প্রাণপ্রিয়, পরমাত্মা বা ব্রহ্মের মধ্যে বিলীন বা একাত্ম হয়ে যাওয়াই বাউল সাধকের কাছে ‘জ্যান্তে- মরা’। লালন ফকির সাধনার এই পর্যায় বা অবস্থাকে বলেছেন ‘আত্মবিলোপ’। এই ‘জ্যান্তে- মরা’ বাউলের অন্যতম মহাতত্ত্ব। কবীর বলেছেন, ‘’জীবত মেঁ মরণা ভলা মরি জানৈ কয়।।“ অর্থাৎ ’যদি মরতে জান তবে জীবন্তেই মর, ইহাই সারপথ।‘


বাউলের সাধন সম্পর্কীয় বিষয়ের মধ্যে রয়েছে শূন্যতত্ত্বের কথাও। শ্রী ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী বলেছেন, ‘’শূন্যতত্ত্ব বাউলদের এক বড় কথা। কবীর তো শূন্যের ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ। তাহার পূর্বেও যোগশাস্ত্রে দেখি, আকাশে থাকিলে, কুম্ভের ভিতরে- বাহিরে শূন্য। অর্ণবে থাকিলে, ভিতরে- বাহিরে পূর্ণ।‘’ কবীরের বিশ্বাস ছিল, ’শূন্যের মধ্যেই বিমল আশ্রয়। আর সেখানেই ইন্দ্রিয়াতীত পুরুষের সহজ স্থান।‘ ‘‘শূন্যকে বীচমে বিমল বৈঠক জহাঁ সহজ অস্থান হৈ গৈবকেরা।।‘’ কবীরের মতে,


‘’পুরব পচ্ছিম দেখ দকখিন

উত্তর রহৈ ঠহরায়কে।

জহাঁ দেখো অগম্য গুরুকী

তহীঁ তত্ত সমায়কে।।“


অর্থাৎ’ ‘পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ, উত্তর চেয়ে দেখ, তিনিই রয়েছেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে। যেখানে দেখ সেখানেই সেই অগম্য গুরুর তত্ত্ব পরিপূর্ণভাবে সমাহিত।‘’


বাউলরা দেহতত্ত্ববাদীও। কায়াযোগ তাদের সাধনপথ। তাঁদের বিশ্বাস ‘যা আছে ভাণ্ডে তাইই ব্রহ্মাণ্ডে’। দেহ এদের কাছে সোনার নৌকা আবার সেখানেই প্রস্ফুটিত হয় ‘অমৃত পুস্প’। এই সত্যই ব্যক্ত হয় তাঁদের সঙ্গীতে- ‘’সোনার নায়ে সোনার বাঁধন/ অমৃতের ফুল ফোটে’’। নারায়ণ উপনিষদেও দেখা যায় একই বক্তব্য, ‘দেহই পুণ্ডরীক।’ ‘’তদদিং পুরং পুন্ডরীকং।।‘’ ছান্দোগ্যেও লেখা আছে ‘দহরাং পুন্ডরীকং বেশ্ম।।‘ অথর্বও বলে, ‘সেই পদ্মেরই কথা জিজ্ঞাসা করি, অপূর্ব রহস্যে যেটি বিশ্বসলিলে ভাসমান’- ‘’ অপাং ত্বা পুষ্পং পৃচ্ছামি যত্র তন মায় মায়য়া হিতম।।’’


বাউল, গান, Baul, Song, Gaan, সূফী, বৈষ্ণব ,শাক্ত
বাউল গানের সন্ধানে | In Search of Baul Song

কোন কারণে ও কিভাবে এই দেহকমল ফোটে তার রহস্য উপলব্ধি করা যায় একমাত্র সাধনার দ্বারা। সেক্ষেত্রে দেহমধ্যস্থ পথ অবলম্বন করেই অগ্রসর হতে হয়। এই পুন্ডরীক দেহের নবদ্বার। অন্তরময় পুরুষ অবস্থান করেন বাইরে আবার অন্তরেও। দাদূরের কায়াবলীতে দেখা যায় সেই বিশ্বাসের প্রতিভাস-


কায়া মাঁহে সিরজনহার।

কায়া মাহে ওঁকার।।

কায়া মাঁহে হৈ আকাশ।

কায়া মাঁহে ধরতী পাশ ।।

কায়া মাঁহে পবন প্রকাশ

কায়া মাঁহে নীর নিবাস।।

কায়া মাহে সসিহর সুর।

কায়া মাঁহে বাজৈ তুর।।

কায়া মাঁহে খেল পসারা।

কায়া মাঁহে প্রাণ অধারা।।


অর্থাৎ ‘কায়ার মধ্যেই ওঁকার, সৃষ্টিকর্তা, আকাশ, ধরণী - পরশ, পবন - প্রকাশ, নীর, চন্দ্রসূর্য, তুরের বাজনা, ব্রহ্মা- বিষ্ণু- শিবাদি।‘ ‘দাদূ বিশ্বাস করতেন যেখানে হংস বসত করে সেখানেই শূন্য বা কাম্য মানস সরোবর। সেই অনন্ত শূন্যের অবস্থান মানবের দেহমন্দিরস্থ হৃদয়ে।‘ সাধক বাউল তাই বলেন, ‘’এইবেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন’’। তা না করলে ‘যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে/ কোন ঘরে সে বসে আছে’ তা ‘আঠারো মকাম’- এর মধ্য থেকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে। বাউলদের ব্যবহৃত ‘গুরু’ শব্দটির ‘গু’ অর্থ অন্ধকার, ’রু’- এর অর্থ রোশনাই বা আলোর ছটা। গুরু হলেন মানুষের অন্তরস্থ সেই সত্ত্বা যাকে উপলব্ধি করতে পারলে মনের সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়, চৈতন্যজগতে উদিত হয় ‘অমাবস্যার চাঁদ’। তখন সাধক চাক্ষুষ করেন, ‘জলের ভিতর জ্বলছে বাতি ভাবনগরে’। এই দুর্লভ প্রাপ্তির পূর্ব সময় পর্যন্ত সাধক ব্যাকুল হয়ে খুঁজে ফেরে তার কাম্যকে অর্থাৎ পরমাত্মাকে। অনেক ভ্রান্ত পথচারী যখন পথ খুঁজে পায় তখন সেই ভুলের কথাও তাঁরা ব্যক্ত করে গানের মধ্য দিয়ে-


‘’আমি মনমন্দিরে পূজা দেব

শিবম- সুন্দরম- অনন্তম।

আমি গির্জায় গিয়ে যীশু খুঁজব

কৃষ্ণ খুঁজি মন্দিরে।

আমি মসজিদে গিয়ে আল্লা খুঁজি

খুঁজি না তো অন্তরে।‘’


বাউল বলে,’ ‘মনের মানুষ মনের মাঝে কর অন্বেষণ।‘’ এই অন্বেষণ শেষে জানা যায় সত্যকে -


‘‘দেহের গুরু আছে কেবা

শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা

যে দিনেতে জানতে পাবা

মনের ঘোর যাবে তখন।‘’


বাউলের সাধনপদ্ধতির মধ্যে আছে বিশেষ মৈথুন প্রক্রিয়া এবং সেখানে প্রতি মুহূর্তে থাকে বিচ্যুতির সম্ভবনা। তাই জটিল দেহমধ্যস্থ অটল সত্যকে জানতে হলে প্রয়োজন জিজ্ঞাসু মন, একাগ্রচিত্ত, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা। অনেকের মতে বৌদ্ধ সহজিয়া এবং নাথ ধর্মের মধ্যে যে দেহকেন্দ্রিক সাধনা তার সাথে বাউল সাধনার কিছু সাদৃশ্য আছে। প্রসঙ্গক্রমে চর্যাপদের (১০ম- ১২শ শতাব্দী) দেহসাধনা সম্পর্কীয় পদগুলি থেকে লুইপাদ কর্তৃক রচিত একটি পদের কিয়দংশ উল্লেখ্য-


‘’কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।

চঞ্চল চীএ পইঠ কাল।।

দিট করিঅ মহাসুখ পরিমাণ।

লুই ভণুই গুরু পুচ্ছিত জান।।‘’


অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতার কারণে ক্ষতি- এমন কি মৃত্যুও হতে পারে। সেইজন্য দেহসাধনার মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌছাতে হলে গুরু নির্দেশিত পথ অবলম্বন করাই সর্বোত্তম পন্থা। মৈথুনের মাধ্যমে ইড়া- পিঙ্গলার (গঙ্গা- যমুনার) মধ্য দিয়ে যেতে হয় সুষুম্নাতে (সরস্বতী)। এই তিনের সম্মিলিত রূপ বা অবস্থাকেই বলা হয় ‘ত্রিবেণী’। এই পথ ধরে বিন্দু যখন পৌঁছে যায় সহস্রারে বা মস্তকে অবস্থিত পদ্মদলে, তখন অনুভূত হয় মহাভাব অর্থাৎ ‘সহজ অবস্থা’। প্রসঙ্গক্রমে তন্ত্র এবং নাথ সম্পর্কীয় যোগসাধনার কথা স্মরণে আসে। এ যেন শিবশক্তির দেহাত্মক সাধনা। অনেকের মতে শ্বাস- প্রশ্বাস নির্ভর ক্রিয়া বলে এই সাধনার নামই ‘বাউল সাধনা’। এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, সংস্কৃত ‘বায়ু’ শব্দ থেকে বাংলায় এসেছে ‘বাই’ বা ‘বাউ’, এর সাথে ‘ল’ প্রত্যয় যোগ করে এসেছে ‘বাউল’ শব্দটি। মনে রাখতে হবে দু- চারটে শব্দ বা বাক্য দিয়ে এদের ‘গুপ্তিপাড়ার গুপ্তকথা’ বলা অথবা সাধনাক্রিয়ার মর্মার্থ অনুভব করা সম্ভব নয় শুধু আভাসের মধ্যে খুঁজে বেড়ানো মাত্র।মনে রাখতে হবে, বাউলদের মৈথুনতত্ত্ব কিন্তু সূফী এবং বৈষ্ণবদের দ্বারা গৃহীত হয় নি। এই দুটিতে প্রধানত আছে সহজ সাধনা। অনেকের মতে, উপনিষদের ‘পরমাত্মা’, সূফীদের ‘প্রিয়তম’, বৈষ্ণবদের ‘সহজ’- এই তিনটির সম্মিলিত রূপই যেন বাউলদের ‘অধর মানুষ’, মনের মানুষ’, ‘আলোক সাঁই’……। সুফীরাও খুঁজে বেড়ান কোনও সত্ত্বাকে। তাদের মনের মানুষ ‘ইলা- ই- লাহা, লা- শরিকাল’। লালনের গানে যে ‘আলেক সাঁই- এর কথা শোনা যায় তিনি এক রহস্যময় পুরুষ। আর সূফী ভাবনায় আছে ‘আনা’ল হক (I am the real). বাউল আর সুফী উভয়েই অজানার অনুসন্ধানরত। এরা প্রেমের মাধ্যমে অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার পথে চলে দুর্জ্ঞেয় রহস্য উদ্ঘাটন করতে সচেষ্ট থাকেন। এরা যেন প্রেমপাগল বা উন্মাদ। রবীন্দ্রনাথের ছন্দভরা, প্রাণ মাতানো গানেও কোনো অজানাকে পাওয়ার আকুলতায় মথিত হয়েছে আকাশ- বাতাস, চতুর্দিক। অন্তর থেকে উৎসারিত হয়েছে প্রেমারতি আর সাধনার ব্যঞ্জনা -


‘’ভেঙে মোর ঘরের চাবি

নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার।

না পেয়ে তোমার দেখা একা একা

দিন যে আমার কাটে না রে।‘’


আরাধ্যর স্বরূপসন্ধানের পথ, তার দুর্জ্ঞেয় রহস্য জ্ঞাত হওয়া ও লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য বাউল যান গুরুর কাছে আর সূফী পৌঁছান পীরের দ্বারে। এদের মধ্যে কিছুক্ষেত্রে সাদৃশ্য থাকলেও অনেক পার্থক্যও আছে। সূফীরা ইসলাম অর্থাৎ আল্লা নির্ভর কিন্তু বাউল তাঁর পথ খুঁজে ফেরে নিজস্ব চিন্তার আলোকে। আথচ উভয়ের কাছেই উপেক্ষিত হয় প্রথানুসারী পূজাপাঠ, আচার অনুষ্ঠানাদি।


‘’আমার নাই মন্দির কি মসজিদ

পূজা কি বকরিদ

তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী

পলে পলে সুদিক।


কেউ কেউ মনে করেন, বাউলতত্ত্ব সূফী একেরশ্বরবাদ, আত্ম- অনুসন্ধান এবং আত্মোপলব্ধি আর বৈষ্ণবীয় প্রেমের মূল ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে। ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন যে বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া এবং সূফীবাদ- এই তিন সাধনতত্ত্বের ঐতিহ্যের মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল ‘বাউল’ নামক ধর্মসম্প্রদায়।


‘’আলেখ দুনিয়ার বীজে আলেখে সাঁই বিরাজে

আলেখে খবর নিছে, আলেখে কয় কথা।‘’


বৈষ্ণবদের আছে প্রেম, বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনা নিষ্কাম আর সূফীদের ‘আঠারো মোকাম’- এর মধ্যে চলে ‘মহারস’। সেই সাথে সূফীদের আছে আরো চারটি মোকাম- নাসুত, মল্কুত জব্রুত ও লাহুত। ডঃ আহমেদ শরীফের সংকলিত গ্রন্থ ‘বাউলতত্ত্ব’- র একটি দেহ তত্ত্বমূলক গানেও এই বাইশ মোকামের কথা আছে। বাইশ মোকামে রয়েছে ঘোড়া, চৌষট্টি কুঠুরি যা রসেতে পোরা। সূফী কায়সাধনার লক্ষ্য চক্রস্থিত কায়সাধনার ধ্যান করতে করতে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করার পর যখন সাধকের সবটাই আলোকপ্রাপ্ত হবে তখন মূল আলোকচক্রের সাথে (আল্লাহ) মিলন ঘটানো। বৌদ্ধ চারকায়ের মত এখানেও কল্পিত হয়েছে চার তন- লতিফু, কসিফু, ফানি, বাকাউ। ভারতীয় যোগতন্ত্রের দেহের যে চক্রের নাম ‘অনাহত’ সূফীদের কাছে সেটি ‘কলব’। সূফীদের সাধনার নাম ‘লতিফা‘। এর লক্ষ্য হল ‘বাকাউ’ বা আল্লাহের মধ্যে আত্মবিলোপ। এ যেন ‘শক্তিতন্ত্রের শিব- শক্তির সাযুজ্য- সাধনা’। আবার বাউল গানের সাথে মিল আছে এই ‘ লতিফা’- র। আগেই বলেছি, লালন যাকে ‘আত্মবিলোপ’ বলে বুঝিয়েছেন বাউল মতে সেই অবস্থাই ‘জ্যান্তে- মরা’। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণপ্রেমে সমর্পিতপ্রাণ। এদের সাধনা প্রেমমারগীয়। বৈষ্ণবদের রূপানুরাগ সূফীদের ‘সোহাগ’, কৃষ্ণবিরহ হয় ‘হাল’। সূফীরা সোহাগ- হাল- ত্বলব প্রভৃতি পর্যায় অতিক্রম করে আল্লাহতাল্লার অস্তিত্বের মধ্যে লীন হয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে। আবার রামসুন্দর বাউলের ‘মানুষ’, ‘মনের মানুষ’ কোনো কোনো সময় কল্পিত হয়েছে শাক্ত ধর্মের আরাধ্যা শ্যামল বরণ রমণীরূপে-


‘’শুন বলি অজ্ঞান মন

দেহের মধ্যে আছে কন্যা শ্যামল বরণ।

রামসুন্দর কহে শুনরে পাষাণমন,

এই কন্যাটির সাধন ভজন চিনেছে যে জন

শক্তি মুক্তি ভক্তি শক্তি তার পরম ধন।‘’

(হারামণি, ৭ম খন্ড)


মুর্শিদ গানের মুর্শিদ ভজনার সাথেও বাউল গানের মিল আছে। মুর্শিদ গানে যে ফুল ফোটার কথা পাওয়া যায় তার সাথে বাউলদের গোপন সাধনার রূপক রূপে ফুল ফোঁটার সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। কিন্তু ‘বাউল’ একটি ধর্মীয় বিশ্বাস হলেও এটি একটি বিশেষ জীবনকেন্দ্রিক জীবনচর্যা যেখানে আছে মানবতাধর্মী সমন্বয়বাদ। যা কিছু মানুষের মধ্যে বিভেদ এনে দেয় তার বিরোধী এরা। সেজন্যই এদের কণ্ঠে শোনা যায়,


‘’কার বা জাতি কেবা দেখে ঘরে এলে চিহ্ন কি

জেতে অন্ন নাহি দিবে, রোগে না ছাড়িবে

মৃত্যু হলে যাবে চলে, জাতির উপায় হবে কি।‘’


তাই সব ধর্মের মানুষের জন্য বাউলের দ্বার উন্মুক্ত। এদের গানে ব্যঞ্জিত হয় গুপ্ত সাধনার সাথে সাথে মনোগ্রাহী মানবতার কথাও। এখানেই এদের স্বাতন্ত্র। বাউলের সত্যনিষ্ঠ ও সরল জীবনযাপন, সমন্বয়বাদী মানসিকতা এবং আদর্শপ্রচার মানুষকে আকৃষ্ট করেছে- আজও করে। বাউলের নেই শাস্ত্রীয় কিতাব অথবা নির্দিষ্ট মন্ত্র, নেই আচার- বিচারের ছুৎমার্গ। বাউলের শ্রেয় চেতনায় যেন পুরাণ- কোরান- বাইবেল একসূত্রে গ্রথিত। লালন তাই বলেছেন,


‘’মানুষতত্ত্ব সত্য হয় যার মনে

সে কি অন্য তত্ত্ব মানে।‘’


প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৃষ্ট ও গীত বাউলগান এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভেদাভেদহীন মানসিকতা, মানবতাবাদী জীবনদৃষ্টি, গানের মধ্যস্থ ভাব ও শব্দ চয়ন, সুরের মাধুর্য, সহজ যাপন, আকর্ষণীয় পোশাক যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মন সিংহ, নদীয়া, বীরভূম প্রভৃতি জেলার সীমা অতিক্রম করে অনেক বিশ্ববাসীর কাছে আকর্ষণীয় এবং মনোগ্রাহী হয়ে উঠছে। ২০০৫ খৃষ্টাব্দে ইউনেস্কো বাউলগানকে ‘দি রিপ্রেজেন্টেটিভ অব দি কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ -র তালিকাভুক্ত করে। উপরন্তু ইউনেস্কো বাউলগানের বাণী ও সুর সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য আর্থিক অনুদান দিয়েছিল। ঐ প্রকল্পে বাংলাদেশের ৫০০টি বাউল গান নিয়ে রচিত হয়েছে ‘’বাউলসংগীত’’ নামক বিখ্যাত ও আকর্ষণীয় গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে আছে ১০০টি গানের ইংরাজী অনুবাদ, ১৫০টি গানের স্বরলিপি, কুষ্ঠিয়ার বাউলদের অবিকৃত কথা ও সুরের ‘সি ডি’।


বাউল, গান, Baul, Song, Gaan, সূফী, বৈষ্ণব ,শাক্ত
বাউল গানের সন্ধানে | In Search of Baul Song

বাংলাদেশের গবেষক সাইমন জাকারিয়া জানিয়েছেন, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাউল গানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক গায়ক দেশ- বিদেশে বাউল গান গাইতে গিয়েছেন- প্রশংসা অর্জন করেছেন, উপার্জন করেছেন অর্থও। বিষয়টি এখনও কমবেশি চলমান। যদিও এদের মধ্যে কতজন বাউলের গুহ্য- সাধনতত্ত্ব চর্চা করেন সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাউল গানের মধ্যস্থ লোকধর্মের স্বাভাবিক উদারতা ও শ্রেয়চেতনা, ছন্দের দোলা, ভাবাবেগের স্রোত এবং ব্যতিক্রমী সজ্জার আকর্ষণ মানুষকে খুবই আকৃষ্ট করে। সম্ভবতঃ সে কারণেও অনেকে বাউল, সূফী গানকে পেশা হিসেবে নির্বাচন করে নিয়েছেন। অধুনা দেখা যাচ্ছে সাধনতত্ত্ব ব্যতীত সমসাময়িক কিছু কিছু প্রসঙ্গও বাউল গানে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। তাই বলা যেতেই পারে, মূলমন্ত্র এক থাকলেও কালস্রোতের মত বাউল গানের বিষয়- রূপ- সুর কমবেশি পরিবর্তনশীল। যদিও লোকসংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বাউলদের দর্শন, চর্যা, গান প্রভৃতি সম্পর্কীয় গবেষণা থেমে যায় নি। কিছু ব্যতিক্রম দেখা গেলেও এখনও বাউল গানের মূলরূপ তার সার্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহমান। প্রকৃত বাউলের দেখাও পাওয়া যায়। সূফী এবং তাদের গান সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। এরাও চায় আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন। বাউল এবং সুফীর কাম্যকে পাওয়া কিন্তু সহজ নয়। তাই লালনগীতিতে সদাই আত্মসমীক্ষা ও আকুলতা-


‘’গুরু হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়

ঘিরে নিল কালে।

আর কি হবে মানব জনম

বসব সাধু মেলে।।

কতশত লক্ষযোনি ভ্রমণ করেছ জানি

মানবকুলে মন রে তুমি এসে কি করিলে।।

আর কি হবে মানব জনম

বসব সাধু কুলে।।‘’


পরিশেষে বলা যায়, পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনই বাউলসাধনার মূল ল্ক্ষ্য। এদের আত্মতত্ত্বে আছে মনের প্রস্তুতির কথা, দেহতত্ত্বে মেলে সাধনার নিয়ম ও পদ্ধতি, সৃষ্টিতত্ত্বে আছে জীব সৃষ্টির রহস্য, গুরুতত্ত্বে গুরুর ভূমিকা এবং গুরুর শরণ আর মনুষ্যতত্ত্বে ব্যক্ত হয়েছে পরমাত্মার সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষা। ডঃ ব্রতীশ ঘোষ এই আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘’এ হ’ল অনন্তের জন্য সান্তর ব্যাকুলতা; যে ব্যাকুলতা ধ্বনিত হয়েছে জগতের সকল মরমিয়া সাধকের কাব্যে- সলোমানের গানে, সেন্ট ক্যাথারিনের রচনায়, জালালুদ্দীন রুমি ও হাফেজের গজলে, দাদু- কবীর রজ্জাবের দোঁহায়, মহাজন পদাবলী ও কবীরের দোঁহায়, বাউল সঙ্গীতে। এই অনন্ত প্রতীক্ষায় রাত্রির অবসান নেই, তাই এই মরমীদের কথা শেষ হয়েও অসমাপ্ত থেকে যায়।‘’




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 21.04.2024)


সাহায্য গ্রহণ:

১. সূফী সাহিত্য- সংস্কৃতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ- ডঃ ব্রতীশ ঘোষ
২. বাংলার বাউল- শ্রীক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী
৩. রবীন্দ্রনাথের সংগীত চিন্তার নানা দিক- সংকলন ও সম্পাদনা ড. গৌতম নাগ
৪. বাউল তত্ত্ব- ডঃ আহমদ শরীফ
৫. কবীর- ক্ষিতি মোহন সেন
৬. উইকিপিডিয়া


নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।