ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore

ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা

Jamindari in Bengal from Odisha, The story of the rise and fall of the Khirpai Pahari clan



চিন্ময় দাশ।



Home » Medinikatha Journal » Chinmoy Das » ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা


ওড়িশার শাসনে মেদিনীপুর

দ্বাদশ শতকের প্রায় শুরু থেকে ষোড়শ শতকের একেবারে মাঝামাঝি সময়। দীর্ঘ সাড়ে চারশো বছরের এক কালপর্ব। দ্বাদশ শতকের গোড়ায় ওড়িশার রাজা ছিলেন অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গদেব। মেদিনীপুর জেলার বিশাল এলাকা অধিকার করে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর অনঙ্গভীম দেব, সূর্যবংশীয় রাজা প্রতাপরুদ্রদেব এবং সর্বশেষ হরিচন্দন মুকুন্দদেব (মৃত্যু ১৫৬৪ সাল) একই ধারায় হেঁটেছিলেন। ওড়িশার নৃপতিরা সকলেই, মেদিনীপুর জেলার সিংহভাগ অংশ অধিকার করে রেখেছিলেন। পাঠান শাসক সোলেমান কররানি ওড়িশা আক্রমণ এবং অধিকার করলে, মেদিনীপুর জেলায় ওড়িশার নৃপতিদের অধিকার সমাপ্ত হয়েছিল।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

কলিঙ্গ রাজাদের শাসনকালে, রাজানুগ্রহ কিংবা রাজানুমোদন পাওয়া বহু ব্যক্তি, বাংলার মেদিনীপুর জেলায় চলে এসে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁরা ছাড়াও বেশ কিছু ভিন্ন ব্যক্তিও ছিলেন, যাঁরা নিজেদের পুরুষকার বলে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন।


এই দলে ছিলেন বহুসংখ্যক ভাগ্যান্বেষী উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষ। প্রতিবেশী জেলা হিসেবে, মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে জমিদারিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কেউ কেউ। মেদিনীপুর শহরের বিখ্যাত এবং বড় জমিদার ছিল মল্লিকবংশ। এই বংশটিও এসেছিল ওড়িশা রাজ্য থেকে।

পাহাড়ী বংশের কথকতা

আজকের এই নিবন্ধে পাহাড়ী পদবীর একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের কথকতা। তাঁরা এসেছিলেন ওড়িশার জাজপুর থেকে। মেদিনীপুর জেলার উত্তরতম প্রান্তের ক্ষীরপাই নগরীতে এসে বসতি করেছিলেন তাঁরা। সেদিন থেকে শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি-কথ্যভাষা— সবেতেই বাঙালী হয়ে উঠেছিল পরিবারটি।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

ওড়িশা রাজ্য বিগত এক হাজার বছর ধরে, শৈব আরাধনার অগ্রভূমি। বৌদ্ধ ধর্মের পতনের সূচনা কাল থেকে, সেখানে শৈবধর্মের বিশেষ প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করেছিল। অষ্টম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালে, কলিঙ্গ প্রদেশের শাসক কিশোরীবংশ শৈব আরাধনার শক্ত ভিত গড়ে দিয়েছিল সেখানে।



পাহাড়ীবংশও ওড়িশা থেকে শৈব আরাধনার উত্তরাধিকার বহন করে এনেছিলেন। ক্ষীরপাইতে বারোটি শিবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা। তবে, তাঁদের কুলদেবী ছিলেন ‘সিংহবাহিনী’ নামে দেবী দুর্গা। কুলদেবীর পায়ে ফুল না চাপিয়ে, জলস্পর্শও করতেন না পাহাড়ীরা।


রেশম শিল্পের রমরমা :


পাহাড়িরা যখন ক্ষীরপাইতে এলেন, বয়নশিল্পের রমরমা চলছে সেখানে। পট্টবস্ত্রের সাথে বিশেষ সুনাম গড়ে উঠেছিল রেশমশিল্পের। সেই সুনামের সুবাদে বিদেশি বণিকেরাও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলায় পৌঁছে গিয়েছিল। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ কে আসেনি? সমগ্র ঘাটাল মহকুমাতে আবির্ভাব ঘটেছিল ইউরোপীয় বণিকদের।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

১৭৬০ সালে নবাব মীর কাসিমের কাছ থেকে মেদিনীপুরের বন্দোবস্ত পেয়েছিল ইংরেজরা। কিন্তু ইংরেজদের দাপট ছিল তার পূর্বকাল থেকেই। তাদের দাপটে পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ বণিকদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। থেকে যেতে পেরেছিল কেবল ফরাসি ব্যবসায়ীরাই। ক্ষীরপাই নগরেও ফরাসিদের রেশমকুঠি গড়ে উঠেছিল।


ক্ষীরপাই এবং অনতিদুরের রাধানগর এলাকায় সুতি এবং রেশমের মূল্যবান কাপড় উৎপাদন হতো। জানা যায় স্বয়ং ভারত সম্রাট ঔরঙ্গজেব, তাঁর হারেমের রমণীদের জন্য, জাহাজ ভর্তি করে রেশমি রুমাল নিয়ে যেতেন এই এলাকা থেকে।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

যাইহোক, ফরাসি এবং ইংরেজ রেসিডেন্টরা লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার করতেন ক্ষীরপাই এলাকায়। কুঠির পরিচালক রেসিডেন্টরা ছাড়াও, স্থানীয় মহাজন, সুতি ও রেশম বস্ত্রের উৎপাদক তন্তুবায়শ্রেণী, রেশম ও তুলার চাষী, ব্যবসায়ীগ্ণ অনেকেই ব্যবসা বাণিজ্যে সামিল হয়েছিলেন। তা থেকে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হতে পেরেছিলেন তাঁরা। পাহাড়ীরাও উড়িষ্যা থেকে এসে, রেশনশিল্পকেই বেছে নিয়েছিলেন জীবিকা হিসেবে।


পাহাড়ীদের ব্যবসা ছিল বেশ বড় মাপের। ঘাটাল শহর থেকে রূপনারায়ণ নদীপথে কলকাতা পৌঁছতে হতো। তারপর কলকাতা থেকে জাহাজ যোগে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেত পাহাড়ীদের জাহাজ। ঘাটালের কুঠিঘাট আর কলকাতায় নিজেদের ‘গদি’ তৈরি করেছিলেন পাহাড়ীরা। তাতে বিদেশে মাল রপ্তানির কাজ করতে সুবিধা হতো তাদের।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

দূরদর্শী ছিলেন পাহাড়ীবংশের কর্তারা। তাঁরা জানতেন, লক্ষ্মী চিরকাল চঞ্চলা। তাঁকে বেঁধে রাখতে হয়। রেশম ব্যবসার অগাধ সম্পদ থেকে, সম্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। জমিদারি প্রতিষ্ঠা করবেন মনস্থ করে, গোটা একটা তালুক কিনে নিয়েছিলেন। তা থেকে ‘তালুকদার’ হয়ে উঠেছিল এই পরিবার। বিভিন্ন গ্রন্থে আজও ‘তালুকদার বংশ’ হিসেবে তাঁদের উল্লেখ পাওয়া যায়।



দেবী দুর্গার মন্দিরটি গড়েছিলেন নিজেদের অট্টালিকার পূর্বদিকে। এখানে দেবীর নাম সিংহবাহিনী। অষ্টধাতুতে তৈরি মাঝারি মাপের মূর্তি।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পাহাড়ি পরিবারের কর্তা কে ছিলেন, অর্থাৎ কার হাতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার উল্লেখ নাই কোথাও। তবে সিংহবাহিনীর মন্দিরটি বর্তমানে বেশ জীর্ণ এবং পরিত্যক্ত। সেই মন্দিরে যে প্রতিষ্ঠ- ফলকটি আছে, সেটিও ভারি জীর্ণ। তবে, সেই ফলক থেকে এটি উদ্ধার করা যায় যে, ইংরেজি ১৭৪৬ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের তখনও এক দশক দেরি। অর্থাৎ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখলের বেশ কিছুকাল পূর্বেই, পাহাড়ীবংশ ওড়িশা থেকে এই জেলায় এসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।


চৈতন্যদেবের প্রেমধর্ম প্রচারের পূর্বকাল থেকে, এই অঞ্চলে শৈব এবং শাক্ত দুই ধারায় দেবসেবার প্রচলন ছিল। ক্ষীরপাই থেকে কিছুটা পূর্বে বরদাগড়। ইতিহাসখ্যাত রাজা শোভা সিংহের রাজধানী ছিল সেখানে। শোভা সিংহ তাঁর ইষ্টদেবী বিশালাক্ষীর মন্দিরটিও বরদাগড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

বহু প্রাচীন শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত আছে এই এলাকায়। পাহাড়ীবংশের সিংহবাহিনীর এই মন্দিরে দেবীর বিগ্রহ ছাড়া, তিনটি শিবলিঙ্গও পূজিত হয়। এই পরিবার সেগুলিকে ‘পার্থিব শিব’ নামে উল্লেখ করে থাকেন। এ ছাড়া পার্শ্বদেবতা হিসেবে রাধারানী, গোপাল এবং রঘুনাথ শিলাও আছে এই মন্দিরে। একসময় দক্ষিণবঙ্গের সমগ্র মেদিনীপুর জেলা জুড়ে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের যে গভীর প্রভাব পড়েছিল, শক্তিমন্দিরে এই তিন দেবদেবীর অধিষ্ঠান তারই ফলশ্রুতি।


রাধারানী এবং গোপালের বিগ্রহ দুটি ধাতু নির্মিত। ভগবান বিষ্ণুর প্রতিভু ‘রঘুনাথ’ আছেন শালগ্রাম শিলা রূপে। শাস্ত্রে ৫১টি শালগ্রামের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান শিলার সংখ্যা ১৮টি। সেই তালিকায় রঘুনাথ শিলার স্থান তৃতীয়।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

পৌরাণিক দেব-দেবীদের সাথে লোকদেবী শীতলাও এই মন্দিরে পূজা পেয়ে থাকেন। একটি হেমঘটে দেবীর অধিষ্ঠান।


সেবাইতবর্গের কথা :


একটি বিষয়ের বিশেষ উল্লেখ করা দরকার। বনেদি পাহাড়ী পরিবারের ‘বংশলতিকা’র অনুসন্ধান করবার সময়, একটি ফলক দেখানো হয় আমাদের। বসতবাড়ির অট্টালিকার দেওয়ালে, একটি মর্মর ফলকে সম্পূর্ণ বংশাবলী উল্লেখ করে, দেওয়ালে সাঁটা আছে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ঘাটশিলাতে ধলভূমগড় রাজবংশের অনুরূপ একটি বংশলতিকা আমরা পেয়েছিলাম। দেওয়াল জোড়া বিশালাকার শ্বেতপাথরের ফলকটি কাছারিবাড়ির দেওয়ালে লাগানো আছে। বর্তমানে সেই কাছারিবাড়ি রাজ্য সরকারের দপ্তর হিসেবে পরিচালিত হয়।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

যাইহোক, পাহাড়ীদেরবংশলতিকাটি এখানে উল্লেখ করা হলো। তবে, বিশদ বিবরণে গিয়ে প্রয়োজন নাই। কেবলমাত্র বংশের শরীকগণের যে অংশটি দেবীর সেবা পূজার সাথে যুক্ত আছেন, সেটুকু উল্লেখ করে দেওয়া যেতে পারে।


কুমুদকান্ত পাহাড়ীর চারজন পুত্র—শম্ভুনাথ, বিশ্বনাথ, রঘুনাথ এবং গোপীনাথ। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁদের কোন বংশধারা নাই। বিশ্বনাথের দুই পুত্র-- বীরেশ্বর এবং প্রণব। রঘুনাথের একমাত্র পুত্র লক্ষ্মীকান্ত।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

এই দুটি পরিবারই দেবীর সেবাইত হিসেবে বহাল আছেন। তাঁরা যৌথভাবে মন্দিরের সেবা পুজো পরিচালনা করে থাকেন।


দেবালয়গুলির একেবারে প্রতিষ্ঠাকালে, চক্রবর্তী পদবীর একটি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশ এই মন্দিরে পৌরহিত্যকর্মে যুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমানেও তাঁরাই এই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

প্রথম দিন থেকে টানা দুশো বছর বিশেষ আড়ম্বরের সাথে দেবদেবীদের পূজার আয়োজন হতো। দূর্যোগের সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে।



আমরা আগেই জানিয়েছি পাহাড়ীবংশের আর্থিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল রেশম ব্যবসা থেকে। এঁদের রেশম রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ যুক্ত ছিল পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে। টানা ৬ বছর, ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫-- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায়, ব্যবসাটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সেসময় আকাশে বাতাসে এই সাবধান বাণী শোনা যাচ্ছিল, কলকাতা নগরীতে জাপানি বোমা পতন হতে পারে। সেই আশঙ্কায় বিদেশী জাহাজের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কলকাতা বন্দরে। তা থেকেই সর্বনাশ ঘটেছিল পাহাড়ীদের। বিদেশে রপ্তানি করা রেশমদ্রব্যের মূল্য হিসেবে, বিপুল পরিমাণ অর্থ অনাদায়ী থেকে গিয়েছিল। সেই অর্থ আর আদায় করা হয়নি।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

এই ধাক্কা সামলে উঠে, রেশম ব্যবসা টিকিয়ে ্রাখা সম্ভব হয়নি আর। তখন থেকেই দেবীর সেবা-পূজার আড়ম্বরে ঘাটতি সূচনা হয়। এরপর দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ আঘাত আসে জমিদারি উচ্ছেদ আইনের কারণে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই, জমিদারি ব্যবস্থাটাই উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল রাজ্য থেকে। তার অভিঘাতে পাহাড়ীবংশের আর্থিক বুনিয়াদ যেমন ধসে গিয়েছিল, তেমনি সংকটের সূচনা হয়েছিল দেবীর সেবাপূজা এবং মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণেও।


সেবাপূজ়ার আড়ম্বর যেমন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয়নি মন্দিরগুলিকে জীর্ণতার হাত থেকে রক্ষা করাও।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

সম্বৎসরে দুটি বিশেষ পূজার ব্যবস্থা ছিল দেবীর। শরৎকালীন দুর্গাপূজার নির্ঘণ্টে এবং বসন্তে রামনবমী তিথিতে। দেবী এখানে ধাতুমূর্তিতে পূজিত হন। কিন্তু বিসর্জনের পর সেই বিগ্রহের নিরঞ্জন হয় না। সেকারণে, এক মেড়ে চার পুত্রকন্যা সহ দেবী দুর্গার মাটির প্রতিমা নির্মাণ করে নেওয়া হয়। ভাদ্র মাসের রাধাষ্টমীর দিনে প্রতিমায় মাটি দেওয়া হয়। পূজার বোধনের সময়, মন্দির থেকে দেবীর ধাতু মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়।


মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, গোপাল এবং শালগ্রাম আছেন। ঝুলন, জন্মাষ্টমী, নন্দ উৎসব, রাধাষ্টমী, মকর, দোল ও চাঁচর আয়োজিত হয়।


মন্দির গুলির কথা


দেবী সিংহবাহিনীর মন্দিরটি দালান-রীতির। সামনে খিলানের তিন-দুয়ারী একটি অলিন্দ ছিল। সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কয়েকটি টেরাকোটা ফলক ছিল মন্দিরে। সেগুলিও বর্তমানে ধ্বংসের পথিক। গর্ভগৃহের সিলিংও বিনষ্ট। দেবীর বিগ্রহ বসতবাড়ির ভিতরে রেখে পূজা হয়।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

১২টি শিবালয় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন পাহাড়ীরা। তার মধ্যে দুটি মন্দির করা হয়েছিল বসতবাড়ির বাস্তুভূমির ভেতরে। ‌গাজনের আয়োজন হয় না। তবে, শিবরাত্রি পালিত হয়।



শিবমন্দির দুটি দক্ষিণমুখী। আটচালা হিসেবে নির্মিত। টেরাকোটার কোন ফলক নাই। দুটি করে দ্বারপাল মূর্তি আছে। আর আছে সিদ্ধিদাতা গণেশের দুটি মূর্তি।।


ওড়িশা, বাংলা, জমিদারী, ক্ষীরপাই, পাহাড়ীবংশ, Jamindari, Bengal, Odisha, Khirpai, Pahari, clan, Medinipur, Midnapore
ওড়িশা থেকে এসে বাংলায় জমিদারী ক্ষীরপাইর পাহাড়ীবংশের উত্থান পতনের কথকতা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সারা ভারত তথা বাংলার রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এই জেলার ক্ষীরপাইয়ের পাহাড়ীবংশ একমাত্র পরিবার, যাঁদের আর্থিক মেরুদন্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 30.11.2025)




নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।