মগের মুলুকে জোব চার্নক
Job Charnock in Hijli, Midnapore
দিলীপ মজুমদার।
Home » Medinikatha Journal » Dilip Majumdar » মগের মুলুকে জোব চার্নক
প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা । বঙ্গোপসাগরের হুগলি নদীর মোহানার পশ্চিমদিকে পলি জমে জমে তৈরি হয়েছিল দুটি দ্বীপ । একটির নাম হিজলি , অন্যটির নাম খেজুরি । দুই দ্বীপের মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত এক নদী । নাম তার কাউখালি । স্থানীয় মানুষের কাছে এই নদী ছিল ‘শয়তানের নদী’ । শয়তানের নদী কেন ? কারণ এই নদীতে যাতায়াত ছিল মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের । বড় ভয়ংকর তারা । শয়তানের মতো নিষ্ঠুর । এই নদী দিয়ে যে সব বজরা বা ঝাহাজ চলাচল করত, তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত জলদস্যুরা । আক্রমণ করত , লুটপাট করত , খুন-জখম করত অবলীলাক্রমে । তাই এই অঞ্চলটার নাম হয়েছিল ‘মগের মুলুক’ ।
মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম দিক পর্যন্ত ভারতের সমুদ্র উপকূলে অত্যাচার চালাত পর্তুগিজ জলদস্যুরা । হুসেন শাহের আমলে বাংলার পূর্ব আর দক্ষিণ সীমান্তে হাজির হয় পর্তুগিজদের নৌবহর বা আর্মাডা । এই আর্মাডা শব্দটা স্থানীয় লোকের মুখে পরিণত হয় ‘হার্মাদ’এ । চট্টগ্রাম বন্দরে ডেরা বেঁধেছিল পর্তুগিজরা । সেখানকার মগদের সঙ্গে হাত মেলায় তারা । চট্টগ্রাম অঞ্চলে নামের আগে ‘মং’ লেখার রীতি ছিল । মং থেকে এসেছে মগ । মগ হানাদারদের বাসস্থান হল মগের মুলুক ।
কালের নিয়মে কাউখালি নদী একসময়ে মজে যায় । হিজলি আর খেজুরি যুক্ত হয়ে যায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। কাউখালি নদী পরিণত হয় একটা খালে । তার নাম হয় কুঞ্জপুরের খাল । পাঠান বংশের তাজ খাঁ মসনদ হিজলিকে তাঁর রাজধানী করেন । সেখানে নির্মাণ করেন মসনদ-ই-আলা । মসলন্দীর গীতে আছে :
চারিদিকে লোনা পানি মধ্যেতে হিজলি ।
তাহাতে বাদশাহি করে বাবা মসলন্দী ।।
এই হিজলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে জোব চার্নকের নাম ।
জোব চার্নক
১৬৫০ সাল নাগাদ ল্যাঙ্কশায়ার থেকে ভারতে আসেন জোব চার্নক । ১৬৫৮ সালে তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির উচ্চ পদে বহাল হন । মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ বাধে , তার কারণ কোম্পানির ব্যবসার উপর আবগারি কর দাবি করেন সম্রাট । এই দাবি অগ্রাহ্য করে কোম্পানি । নবাব ক্রুদ্ধ হয়ে কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করেন । কুঠির দায়িত্বে ছিলেন জোব চার্নক । তাঁকে হুগলিতে বদলি করা হলেও অবরোধের জন্য তিনি যেতে পারছিলেন না । হুগলিতে নবাবের ফৌজ তাঁকে আক্রমণ করে । এখানে চার্নক কিভাবে নাকাল হয়েছিলেন তা মোল্লা গৌড়চান নামে এক মুসলমান কবি তাঁর ‘জোবনামা বা ফেরঙ্গমঙ্গল’ কাব্যে বর্ণনা করেছেন :
হুগলির ফৌজদার করি হহুঙ্কার বলে জোবে কান ধরি ।
ফেরঙ্গের বেয়াদপি বরদাস্ত কভি নেহি হাতে দাও দড়ি ।।
প্রাণ বাঁচানোর জন্য নদীপথে সুতানটি চলে যান চার্নক । সেখানে কিছুকাল থাকার পরে তিনি চলে আসেন মেদিনীপুরের ( পূর্ব) হিজলিতে । পরবর্তীকালে এই হিজলির সঙ্গে জড়িয়ে যায় বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’র নাম ।
নদী আর সমুদ্রে ঘেরা হিজলিতে ছিল চমৎকার প্রাকৃতিক সুরক্ষার ব্যবস্থা । চার্নক ভেবেছিলেন এখানে আশ্রয় নিলে হুগলি বা ঢাকা থেকে ফোজ নিয়ে মোগলরা আক্রমণ করতে পারবে না । কিন্তু শায়েস্তা খাঁ চার্নককে জব্দ করার জন্য সেখানে পাঠালেন আবদুল হামিদকে । হামিদ খুব একটা সুবিধে করতে পারেন নি । তখন শায়েস্তা খাঁ পাঠান মালিক কাশেমকে । মালিক কাশেম ঘাঁটি গেড়ে বসলেন রসুলপুরে । গোলন্দাজ সেনাদের আনালেন । চারদিকে তোপখানা বসালেন ।
প্রমাদ গুনলেন চার্নক ।
এখন উপায় ?
এত কম সৈন্য নিয়ে কিভাবে মোকাবিলা করবেন বিপুল মোগল বাহিনীর ? গোদের উপর আবার বিষফোড়া। পেটের অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বহু ইংরেজ সেনা ।
পরের দিন একটু আশার আলো দেখা দিল । নিকলসন চার্নককে জানালেন যে কিছু সৈন্য নিয়ে এসেছেন ক্যাপটেন ডেনহ্যাম । কিন্তু ডেনহভাম যখন শুনলেন মোগল সৈন্যদের সংখ্যা , তখন হতাশ হয়ে পড়লেন তিনি । তিনি বিলক্ষণ চেনেন শায়েস্তা খাঁকে । সাংঘাতিক মানুষ । ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাঁর দুচোখের বিষ। বাংলা থেকে তিনি তাদের উচ্ছেদ করতে চান ।
দিনের বেলায় ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে নেমে মার্চ করতে করতে চার্নকের ফোর্টের দিকে যাচ্ছে সৈন্যেরা।
প্রখর বাস্তব বুদ্ধি ছিল চার্নকের । তিনি একটা কৌশল অবলম্বন করলেন । ডেনহ্যামের জাহাজে মেরেকেটে একশোর মতো সৈন্য ছিল । তারা দিনের বেলায় ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে নেমে মার্চ করতে করতে চার্নকের ফোর্টের দিকে গেল । আবার রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে জাহাজে উঠল । পরের দিন আবার মার্চ করতে করতে ফোর্টের দিকে যেতে লাগল । দূর থেকে মোগলরা সে দৃশ্য দেখে ভাবল জাহাজে আছে প্রচুর সৈন্য । ভয়ে তারা রণে ভঙ্গ দিল ।
যুদ্ধ না করেও যুদ্ধ জয় করলেন চার্নক ।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 29.11.2025)
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।