ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar

ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


Kharagpur "remembered" by sculptor and painter Chintamani Kar


সৌমেন গাঙ্গুলি।



Home » Medinikatha Journal » Soumen Ganguly » ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর



খ্যাতিমান ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের বয়স তখন নব্বইয়ের ঘরে। অসুস্থ হলেও তিনি অবিরাম শিল্প সাধনা করে চলেছেন। কলকাতার কাছে নরেন্দ্রপুর স্টুডিও তাঁর স্থায়ী আবাসস্থল। প্রকাশিত হলো তাঁর আত্মজীবনী "স্মৃতি চিহ্নিত"। প্রকাশক চিরায়ত প্রকাশন। তাঁর স্মৃতিতে ততদিনে জমা হয়ে রয়েছে সারাজীবনের বিপুল অভিজ্ঞতা, আর তিনি অর্জন করেছেন বহু খ্যাতি ও সম্মান। আমরা জানলাম ১৯১৫ সালের ১৯শে এপ্রিল খড়গপুরে তাঁর জন্ম। শৈশবের খড়গপুর তাঁর কাছে ছিল এক স্বপ্নময় রূপকথার জগৎ। চিন্তামণি কর তাঁর 'স্মৃতিচিহ্নিত' গ্রন্থে শৈশবের জীবনে খড়গপুরের অন্তরঙ্গ প্রভাবের কথা তুলে ধরেছেন, যা তাঁর সমগ্র জীবনকে প্রভাবিত করেছে।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


মানুষের জীবনের সঙ্গে শিল্পীর আঁকা ছবির এক আশ্চর্য মিল রয়েছে। একটি ছবি যেমন 'বিন্দু' দিয়ে শুরু হয়, মানুষের জীবনে শৈশব যেন সেই 'বিন্দু'। বিন্দু সাজিয়ে যেমন শিল্পী 'রেখা' তৈরি করেন, তেমনই শৈশবের নানা অভিজ্ঞতা ও দুষ্টুমি নিয়ে কৈশোরের জন্ম হয়। কৈশোরের এই 'রেখা'গুলো মিলেমিশে যৌবনের 'তল' তৈরি করে, যা জীবনের পূর্ণ 'ছবি' হয়ে ওঠে। শৈশব তাই জীবন ছবির এক অনিবার্য আশ্রয়। শিল্পীর স্মৃতিতে যখন শৈশবকে আঁকা হয়, তখন তা এক আলাদা মাত্রা পায়, কারণ শিল্পী প্রকৃতির সজীবতাকে আত্মায় ধারণ করে আনন্দধারায় স্নাত হতে পারেন। শিল্পীর জীবনে তাঁর উদ্দেশ্য, স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও মূল্যবোধ জড়িয়ে থাকে। চিন্তামণি করের জীবনে শৈশবের খড়গপুরই তাঁকে সমৃদ্ধি ও বিস্তারের অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও খড়গপুর তাঁর সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাঁর স্মৃতিতে খড়গপুরের আরণ্যক প্রকৃতি ও জাতি-সম্প্রদায়ের সামাজিক অবস্থান সজীব হয়ে ওঠে।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


চিন্তামণি কর বলেছেন যে, শিশুদের মন জীবন সমস্যা বুঝতে অক্ষম বা আঘাত পেলে সহজে ভুলে যায় বলে ধারণা করা হলেও, আসলে তাদের সিদ্ধান্ত ও মীমাংসাগুলো স্মৃতির গভীরে তীব্রভাবে জমে থাকে। তিনি স্মরণ করেছেন তাঁর শৈশবের বন্ধু ভৈয়া, বাপুয়া, আম্মাদের কথা, যাদের জাতবিচার সম্পর্কে তিনি তখনও অবগত ছিলেন না। তিনি কসবায় আসার পর প্রথম জাতিভেদ ও ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার সম্পর্কে জানতে পারেন, যা তাঁর শৈশবের উদার পরিবেশের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তাঁর ঠাকুরমাও এসব সংস্কারের বিরোধী ছিলেন। খড়গপুরের এই 'কসমোপলিটন' বা মিশ্র সংস্কৃতির শহরকেই তিনি গর্বের সঙ্গে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, খড়গপুর শহরের এই বহু ভাষাভাষী মানুষের সংস্পর্শ তাঁকে জ্ঞান ও হৃদয়কে প্রসারিত করার সুযোগ দিয়েছে। চিন্তামণি কর বহু দেশ ঘুরে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও জানান যে, তাঁর জন্মস্থান খড়গপুরই তাঁকে খোলা মন ও উদার স্বপ্নময় শিল্পীসত্তা দান করেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও বলেছেন যে, বাংলাদেশ শাস্ত্রগত সংস্কারমুক্ত, তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশের এই বিস্তৃতি তার শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও সাধনায় দেখা যায়।


খড়গপুরের শৈশব স্মৃতি


চিন্তামণি করের শৈশবের স্মৃতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকের আবছা ছবি ভেসে ওঠে, যেখানে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ ও বন্দুকের ঝলকানি তাঁর মনে দাগ কেটেছে। তিনি মনে করেন, রেলওয়ে শহর খড়গপুরের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, কেবল এখনকার বিজলি বাতির বদলে তখন জোরালো আর্ক-ল্যাম্প জ্বলত, যা রাতের বেলাকেও দিনের মতো আলোকিত করত। শিল্পীর স্মৃতিতে খড়গপুর শহর এক ঐতিহাসিক অনুভূতি তৈরি করে, যা এক মূল্যবান দলিল। তিনি বর্তমান খড়গপুরের পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বেশ অবগত ছিলেন, তবে 'স্মৃতিচিহ্নিত' পাঠ করে সচেতন পাঠক ঐতিহাসিক অস্তিত্বের নিশ্চিহ্নতাকে অনুভব করতে পারবেন।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


তিনি আরও স্মরণ করেন ছোটবেলায় ফেরিওয়ালাদের কথা, যারা মাথায় ম্যাজিক বাক্স নিয়ে আসত এবং 'আগ্রা কা তাজমহল দেখো, দিল্লী কা কেল্লা দেখো' বলে ছবি দেখাত। এই স্মৃতিগুলো ১৯২০-৩০ সালের খড়গপুরের শৈশবকে আন্দোলিত করেছে। কিন্তু আজকের ডিজিটাল দুনিয়া যেন শৈশবকে শহর জীবন থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে, ফলে ভবিষ্যতে শৈশব আর কোনো স্মৃতি বহন করবে না।


শিশুমনের কল্পনায় প্রকৃতি


চিন্তামণি করের স্মৃতিকথা ইংরেজ কবি টি এস এলিয়টের 'Sudden Light' কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। "Sudden Light" একটি ছোট কবিতা যেখানে কবি একটি অতীতে ফিরে যাওয়ার বা সময়ের এক বিশেষ মুহূর্তে আটকে থাকার অনুভূতি প্রকাশ করছেন।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


কবিতার মূল ভাব হলো, কোনো এক অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে হঠাৎ করেই অতীতের স্মৃতি বর্তমানের সঙ্গে মিশে যায়। কবি যখন একটি বাগানে হাঁটেন, তখন তাঁর মনে হয় যেন তিনি এই মুহূর্তটি আগেও বহুবার অনুভব করেছেন। তিনি অনুভব করেন যে এই স্থানটি, এই আলো, এবং এই বিশেষ মুহূর্তটি তাঁর কাছে খুব পরিচিত। এমনকি তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিটিও যেন সেই পুরোনো সময়েরই অংশ।



কবিতাটিতে কবি সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহকে অস্বীকার করে একটি চিরন্তন মুহূর্তের কথা বলেন, যেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়। এই অনুভূতিটি হলো যেন সময় থমকে গেছে এবং একটি নির্দিষ্ট স্মৃতি বারবার ফিরে আসছে। এটি এক ধরনের deja vu-এর (আগে দেখা হয়েছে এমন অনুভূতি) মতো, কিন্তু আরও গভীর এবং দার্শনিক। কবি শেষ পর্যন্ত এই রহস্যময় অনুভূতির কারণ অনুসন্ধান করেন না, বরং এর সৌন্দর্য এবং অদ্ভুততাকে গ্রহণ করেন।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


শৈশবের খড়গপুরে ঘটে যাওয়া 'আলোক নির্ঝর' তাঁর জীবনে হৃদয়-নির্ঝর হয়ে সংবেদনশীলতাকে জাগিয়ে তুলেছিল। তাঁর বাড়ির সীমানা ঘেঁষে একটি বাঁশবন ছিল, যা তখনো শহরের প্রসারে গ্রাস হয়ে যায়নি। এই বাঁশবন ছিল তাঁর কল্পনার রঙ্গমঞ্চ, যেখানে তিনি রোমাঞ্চকর অভিযানের অভিনয় করতেন। তিনি কচি বাঁশের অঙ্কুরগুলির বৃদ্ধি মেপে তাদের দৈনিক বর্ধন পরিমাপ করার চেষ্টা করতেন। এই নির্জন বনের গভীরে লুকানো ছিল কত রূপকথার রহস্য। অন্যের চোখে উন্মুক্ত হলেও, তিনি এর মধ্যে লোহার প্রাচীরে ঘেরা রাজপুরী দেখতেন, যার সিংহদ্বারে এক অতিকায় দৈত্য পাহারা দিত। তার ভয়ে প্রজাপতি, ফড়িং ও গিরগিটিরাও নিঃশব্দে চলাচল করত। ঝিঁঝিঁ পোকাদের একটানা সুরও নিরবচ্ছিন্নতার পরিবেশকে ভঙ্গ করতে সাহস করত না।



তিনি বুনো লতার ডগাগুলো বেঁধে জাল বুনতেন, যা পরে পাতায় ভরা এক মনোরম চাঁদোয়া তৈরি করত। তারই নিচে শুকনো পাতার স্তূপকে গদি বানিয়ে তাঁর সিংহাসন হতো। তিনি ভাবতেন যে, আশেপাশের কীটপতঙ্গরা আসলে মানুষ, যাদের মায়াবী জাদু দিয়ে রূপান্তরিত করেছে। একদিন তিনি আরও জোরালো জাদু শিখে তাদের আবার মানুষে রূপান্তরিত করে মুক্তি দেবেন। তাদের সহচর করে প্রহরী দৈত্যকে বন্দী করে সিংহদ্বার ভেঙে ঘুমন্ত রাজকুমারীর ঘুম ভাঙিয়ে দেবেন। মায়াবীর মায়াজাল উড়িয়ে এনে মুক্তি দেবেন এবং রাজকুমারী তাঁকে ফুলের বরমাল্য দিয়ে পুরস্কৃত করবেন। সাপ, শেয়াল ও ভূতের ভয়ে কেউ সেই বনে প্রবেশ করত না, তাই তাঁর কল্পপুরী নিরাপদ ছিল। কিন্তু মানুষের সান্নিধ্যে শান্তি ক্ষণস্থায়ী হয়, একদিন তাঁর অনুপস্থিতিতে কেউ তাঁর রাজতক্তের অমর্যাদা করে চাঁদোয়া ছিন্নভিন্ন করে দেয়। রাগ ও দুঃখে হৃদয় খান খান হলেও তিনি আবার লতার ছিন্ন ডালগুলোকে সাজিয়ে রাখলেন, হারানো চাঁদোয়া ফিরে পাওয়ার আশায়। পরদিন কোনো দুষ্কৃতকারী শুকনো পাতার স্তূপে আগুন লাগিয়ে দেয়, মুহূর্তের মধ্যে বনটি আগুনের শিখায় ভরে যায়। সমবেত জনমণ্ডলী নিরুপায় হয়ে অগ্নিতরঙ্গের তাণ্ডব দেখছিল। আগুনে বনটি ভস্মীভূত হয়ে কালো পোড়ামাটির এক মাঠে পরিণত হয়, যেখানে বাঁশের পুড়ে যাওয়া গোড়াগুলো কলঙ্কের প্রতিবাদে উত্থিত ছিল।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


বর্ষার পর সেই কালো মাটির রঙ পাল্টে লতাগুল্ম ও নতুন অঙ্কুরের আস্তরণ তৈরি হয়। এই বনে আবার জন্তু, পাখি ও পোকামাকড়ের আনাগোনা শুরু হয়। প্রকৃতির এই পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাঁশ গাছগুলি মাথা দুলিয়ে সাদর আহ্বান জানাতে লাগল। সময় ও প্রকৃতি মানুষের দুষ্কর্মের চিহ্ন প্রায় মুছে দেয়, কিন্তু মনের গভীরে সেই দগ্ধ বনের অঙ্গারগুলি স্মৃতির পর্দায় সেই কলঙ্ককে বারবার স্পষ্ট করে তোলে। মানব ইতিহাসের পাতায়ও এমন অনেক স্তর জমা হয়ে আছে, যেখানে সবুজের আস্তরণের নিচে গুমরানো অঙ্গারের পুঞ্জীভূত স্তর বিদ্যমান। 'স্মৃতিচিহ্নিত' গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন চিন্তামণি কর নিজেই, যেখানে তিনি শৈশবের সেই আগুনস্পর্শী মুহূর্তটিকেই স্থান দিয়েছেন। ২৫২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে দেশ-বিদেশের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্মৃতি বর্ণিত হয়েছে। জীবনের শুরু শৈশব দিয়ে, এবং এই গ্রন্থের শুরুও শৈশবের খড়গপুর দিয়ে, যার প্রমাণ প্রচ্ছদেই রয়েছে। ২০০৪ সালে এই 'স্মৃতিচিহ্নিত' গ্রন্থের জন্য তিনি মনোজমোহন পুরস্কারে ভূষিত হন।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


খড়গপুরে শিশু চিন্তামণি করের 'ফ্লাইং ডাচম্যান' অভিজ্ঞতা


সুপাঠ্য ও রমণীয় গ্রন্থ "স্মৃতি চিহ্নিত " আমাদের শিল্পীর শৈশব জীবনের আরেকটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানায়। পুরনো মালঞ্চের কাছে করদের আদি বাড়ি থেকে শিশু চিন্তামণি কর কীভাবে বর্তমান খড়গপুর টাউন থানায় পৌঁছালেন, তা বিস্ময়কর। তিনি খড়গপুরকে ভোলেননি; ছোটবেলার খড়গপুর তাঁর স্মৃতিসত্তা জুড়ে রয়েছে। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রশাসন এই সড়কের নামকরণ চিন্তামণি করের নামে করতেই পারেন। কারণ এই সড়কের সঙ্গেই তাঁর 'ফ্লাইং ডাচম্যান' হওয়ার অভিজ্ঞতা জড়িত। তিনি বিশ্বাস করেন, ভ্রমণের এক সংস্কার নিয়ে তাঁর জন্ম হয়েছে, অথবা গ্রহের প্রভাবে তাঁকে 'ফ্লাইং ডাচম্যান'-এর মতো প্রচুর ঘুরে বেড়াতে হবে। হাঁটার শক্তি পেতেই তিনি রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন, তাই তাঁকে ডালা ভাঙা কাঠের বাক্সে বন্দী করে রাখা হতো। বাক্স থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল আয়ত্ত করলেও লাভ হয়নি, কারণ বড়রা তাঁর ফন্দি ধরে কোমরে দড়ি বেঁধে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রহের দৃষ্টি যার ওপর পড়েছে, তাকে কি দড়ি দিয়ে আটকানো যায়? তাই একদিন হুডিনির মতো কৌশলে বন্ধনমুক্ত হয়ে সকলের অলক্ষ্যে 'হাঁটি পা পা' করে রাস্তায় নেমে অসীমের দিকে পাড়ি দিলেন। পথে অজানার সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর বেপরোয়া শিশুমন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। যে রাস্তার শেষ নেই বলে মনে হয়েছিল, তা চলতে চলতে হঠাৎ একটি বিরাট গেটের সামনে রুদ্ধ হলো। প্রবেশদ্বারের পাশের সাদা দেওয়ালে একটি অর্ধ-উঁচু হনুমান মূর্তি ছিল, যা তেল ও সিঁদুরের প্রলেপে উজ্জ্বল হয়ে তাঁর চোখে প্রকান্ড ললিপপের মতো লেগেছিল। তিনি সেই মিষ্টির খানিকটা কামড়ে খেতে চাইলেও, তার আগেই এক পুলিশ তাঁকে দেখে প্রশ্ন করা শুরু করে। প্রশ্ন বোঝার বা জবাব দেওয়ার বয়স না হওয়ায়, নির্বাক দেখে পুলিশ তাঁকে গেটের ভেতরের পাঁচিল ঘেরা ময়দানে এক বাংলোয় নিয়ে যায়। সেখানে ইউনিফর্ম পরা একজন ব্যক্তি পুলিশের কাছ থেকে সব শুনে তাঁকে প্রাঙ্গণে খেলা করা একটি ছেলে ও মেয়ের কাছে পৌঁছে দেন। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি বাড়ি পৌঁছে গেছেন এবং তারা তাঁর দিদি ও দাদা। আসলে তিনি থানায় পৌঁছেছিলেন এবং তারা ছিল দারোগার ছেলে ও মেয়ে। তাঁর পরিবার তাঁকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে থানায় খবর দিতে এসেছিলেন এবং সেখানে দেখেন যে, তাঁদের পালিয়ে যাওয়া ছেলে খেলায় বেশ মজে আছে। এতদূরে ছেলেমানুষ কীভাবে পৌঁছালো, সে বিষয়ে তাঁরা ভেবে কোনো হদিস পাননি। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নাকি নতুন পাওয়া দাদা ও দিদির কাছ ছাড়তে ঘোরতর আপত্তি করেছিলেন।


খড়গপুর থেকে কসবা - কেন?


চিন্তামণি কর খড়গপুর থেকে কসবায় আসার কারণও জানিয়েছেন, যা এক দুঃখের বৃত্তান্ত। তাঁদের ছোট্ট পরিবারের ভিত্তি ছিলেন ঠাকুরমা, যার সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে নিকট সম্পর্ক ছিল। ঠাকুরমাকে তিনি খেলার সব সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। মাত্র কয়েক দিনের জ্বরে ঠাকুরমা হঠাৎ মারা যান। সবাই তাঁকে জানান যে তিনি স্বর্গে গেছেন। তিনি ধরে নেন যে ঠাকুরমা তাঁর মতো বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালিয়েছেন, এবং তাঁকে আবার খুঁজে নিয়ে আসা যাবে। ঠাকুরমার স্মৃতিতে ভরা সেই বাড়িতে তাঁকে ছাড়া বাস করা সবার কাছে অসহনীয় হওয়ায় তাঁরা খড়গপুরের পাট উঠিয়ে কসবায় চলে আসেন।


ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, চিন্তামণি কর, খড়গপুর, Kharagpur, sculptor, painter, Chintamani Kar
ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের "স্মৃতিচিহ্নিত" খড়গপুর


শেষ কথা


বাস্তব জীবন সামনে চলে, কালের চাকা তাকে অবিরাম এগিয়ে নিয়ে যায়, এবং এক নির্দিষ্ট সময়ে তাকে নির্বাসনের ঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়। জীবনে পেছনে ফেলে আসা পথে প্রত্যাবর্তন করা যায় না। মনই কেবল স্মৃতিকে সঙ্গী করে ফেলে আসা পথে অবাধে যাতায়াত করতে পারে। এই সংলাপ শুধু চিন্তামণি করের নয়, প্রতিটি ভারতবাসীর। 'স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা' - এ শুধু কাব্য কথা নয়, অতি বাস্তব উচ্চারণ। স্মৃতিকে সঙ্গী করে চিন্তামণি করের পথ পরিক্রমায় খড়গপুরের পাঠককেও শরীক করার চেষ্টাই এই প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য। কারণ 'স্মৃতিচিহ্নিত' গ্রন্থে পৃথিবীখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি কর খড়গপুরকে স্মৃতির রূপকথা দিয়ে অমরতা দান করেছেন।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 31.08.2025)



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।