নাট্যাচার্য, শিশির, কুমার, মেদিনীপুর, সাহিত্য, পরিষদ, Natyacharya, Sisir, Kumar, Bhaduri, Medinipur, Sahitya, Parishad, Midnapore


নাট্যাচার্য শিশির কুমার ও মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদ


Natyacharya Sisir Kumar Bhaduri and Medinipur Sahitya Parishad



অরিন্দম ভৌমিক।




১৯৫৯ সালের ৩০ শে জুন কলকাতার বরাহনগরে নিজের বাড়িতেই নাট্যাচার্য শিশিরকুমার চিরবিদায় নিলেন। ভোরের আলো ফুটতেই বিদ্যুৎ গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল। ২৭৮ বি টি রোডে লোকে-লোকারণ্য। ভিড় সামলাতে নাজেহাল পুলিশ। তার মধ্যে দিয়েই নাট্যাচার্যকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রতনবাবুর মহাশ্মশানে। অশ্রুভেজা চোখে শেষ বারের মতো তাঁকে দেখছে তাঁর ভক্তরা।


এই মহাজীবনের শুরু হয়েছিল মেদিনীপুর শহরের ছোটবাজারে। সালটা ছিল ১৮৮৯ এর ২ রা অক্টোবর। ক্ষুদিরামের জন্মের ঠিক ২ মাস আগে একই শহরে মামারবাড়িতে জন্ম নিলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার।


বাবার নাম হরিদাস ভাদুড়ী। মেদিনীপুরের কৃষ্ণকিশোর আচার্যের প্রথম সন্তান কমলেকামিনীকে বিয়ে করেন এই হরিদাস ভাদুড়ী। হরিদাসবাবু কাজের জন্য বার্মাতে থাকতেন, ফলে মেদিনীপুরে বাপের বাড়িতেই থাকতেন কমলেকামিনী। দাদামশাই কৃষ্ণকিশোরই তখন শিশিরকুমারের অভিভাবক। দাদু কৃষ্ণকিশোরের তত্বাবধানে শুরু হয় শিশু শিশিরের প্রাথমিক পাঠ। দাদামশাই নাতিকে রামায়ণ, মহাভারত থেকে মাইকেল-মধুসূদন পর্যন্ত আবৃত্তি করে শোনাতেন। ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষা মেদিনীপুর শহরেই করেছেন। এখানকার 'মেদিনীপুর টাউন স্কুলে' তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ। দুই মামা দেবকিশোর এবং ফণীন্দ্রকিশোর ছিলেন মেদিনীপুরের নাট্যজগতের প্রতিনিধি। তাঁরা স্থানীয় নাট্যসমাজের সভ্য। ফলে নাটকের প্রতি শিশির কুমার ভাদুড়ীর ভালোবাসা তৈরী হয় দাদু এবং দুই মামার মাধ্যমেই।


অথচ তিনি কলকাতায় বদলি হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর জীবনের এই মেদিনীপুরের অংশটি একেবারেই অনালোচিত রয়ে গেছে। শুধু সেই ছোটবেলাই নয়, কলকাতায় বদলি হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি মেদিনীপুরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। কিন্তু সে খবর আমরা রাখিনি। আজ তেমনই এক ঘটনার কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরব।


নাট্যাচার্য, শিশির, কুমার, মেদিনীপুর, সাহিত্য, পরিষদ, Natyacharya, Sisir, Kumar, Bhaduri, Medinipur, Sahitya, Parishad, Midnapore
বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির। ছবি - অরিন্দম ভৌমিক।

ঘটনাটি ইংরেজি ১৯৫৪ সালের, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর ৫ বছর আগের। এর থেকেই বোঝা যায় মেদিনীপুর শহরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। সেই সময় 'মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদ' চলত 'বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির'-এ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মেদিনীপুর শাখার মুখপত্র ছিল 'মাধবী'। মাধবীর একটি বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল ইংরেজি ১৯৮৭ সালে। সম্পাদনা করেছিলেন শ্রীবিভূতি বন্দোপাধ্যায় এবং শ্রীরাধারমন চক্রবর্তী। সেই পত্রিকার 'পুরাতন প্রসঙ্গ' অংশে আমি এই ঘটনার বিবরণ পাই। অংশটির সংকলন করেছেন শ্রীরাধারমন চক্রবর্তী। আমি কোনরূপ পরিবর্তন না করেই সেই বিবরণটি উল্লেখ করলাম।


নাট্যাচার্য শিশির কুমার ও সাহিত্য পরিষদ


এই সাহিত্য পরিষদের আর্থিক উন্নয়ন বিধানের জন্য অভিনয়ের সাহায্যে কিছু অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা এবং এই প্রস্তাব কার্যকরী করার ভার দেওয়া হল সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার উপর। স্থির হল পরিষদের প্রবীণদের সঙ্গে পরিষদের শুভাকাঙ্ক্ষী নাট্যাচার্য শিশির কুমারকে নিয়ে একটি নাটক অভিনীত হ'লে আর্থিক সঙ্গতির কিছুটা সুবিধা হ'তে পারে।


নাট্যাচার্যের মাতুল বিশিষ্ট শিল্পী ও অভিনেতা শ্রীযুক্ত দেব কিশোর আচার্য। মেদিনীপুরে মাতুলালয়ে, শিশির কুমার জন্মগ্রহণ করেন। মেদিনীপুরের সঙ্গে তাঁর প্রথম জীবনের বহু স্মৃতি জড়িত। তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু এই পরিষদের হিতৈষী ও আজীবন সদস্য শ্রীযুক্ত মন্মথ নাথ দাসের মাধ্যমে শ্রীরঙ্গম নাট্যমন্দিরের দ্বিতলে তাঁকে এই প্রস্তাব জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করেন। এই পরিষদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি কয়েকবার এসেছেন, আবৃতি ও বক্তৃতাও দিয়েছেন। মেদনীপুরের ও পরিষদের অনেক পরিচিত বন্ধু সহপাঠীদের স্মরণ করে উচ্ছাসিত হ'য়ে উঠলেন, বললেন এখন আমার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে, চোখেও ভালো দেখতেও পাইনা। তবুও বন্ধুদের সঙ্গে অভিনয় যা কলেজ জীবনে করেছিলাম, তা আর একবার নিশ্চয়ই করব। এবং সন্ধ্যার দিকে 'মন্মথর' বাসায় এস, ওখানে আমি যাব, ও এ বিষয়ে অন্যান্য আলোচনা করব।



ঠিক সন্ধ্যার পর যথা সময়ে মন্মথ বাবুর বাসায় শিশির বাবু উপস্থিত হ'লেন এবং কথাবার্তার পর পুস্তক নির্বাচন করলেন গিরিশচন্দ্রের "প্রফুল্ল"। তবে সমস্যা হ'ল, জগমনির রোল কে করবে ? বল্লাম, 'আমাদের পরিষদে পেশাদার মহিলা নিয়ে অভিনয় করা নীতি বিরুদ্ধ, তবে যদি বলেন তা হ'লে এমেচার কোন মহিলাকে অনুরোধ করতে হয়। তিনি যেন অবাক হ'লেন, বল্লেন, "এমেচার মহিলা! তিনি কতদিন থিয়েটার করেছেন ? নতুনকে দিয়ে অন্যপাট হতে পারে 'জগমনি' সম্ভব নয়।" মন্মথ বাবু বললেন, "পরিষদে এতদিন যা হ'য়েছে তাই হোক, অর্থাৎ মেয়ের পাট পুরুষেরাই করে, কোন পুরুষই বরং 'জগমনির' পাঠ করুক।" শিশির কুমার হাসলেন এমন এবং অভাবনীয় প্রস্তাবে তিনি স্বীকৃত হলেন এবং মহলার জন্য নাট্যানুষ্ঠানের পূর্ব্বে ৩-৪ বার মেদিনীপুরে আসতে রাজিও হলেন।


নাট্যাচার্য, শিশির, কুমার, মেদিনীপুর, সাহিত্য, পরিষদ, Natyacharya, Sisir, Kumar, Bhaduri, Medinipur, Sahitya, Parishad, Midnapore
‘প্রফুল্ল’ নাটকে শিশির ভাদুড়ী যোগেশের ভূমিকায়।

প্রতিবারই আমি গিয়েছি, তিনি সঙ্গে এসেছেন। পরিষদের সহ-সভাপতি শ্রীযুক্ত সুদাময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে তিনি উঠেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে তিনি হলে' এসে মহলায় যোগ দিয়েছেন। প্রত্যেক পাটের খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি উপদেশ দিয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করতে হ'য়েছে। এইসব পরিবর্তনকে আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করেছেন অভিনেতাগণ। এই মহলা যাঁরা দেখেছেন তাঁরা উপলব্ধি করবেন কি অপূর্ব তাঁর বাচনভঙ্গি, কি সহজ ও সুন্দর তাঁর বিশ্লেষণ। মহলার চিত্তাকর্ষক পদ্ধতির মধ্যেই দেখা যায় তাঁর অভিনয়ের তাৎপর্য। শিশির কুমারের প্রত্যেক ভূমিকাভিনয়ের মধ্যে থাকে তাঁর তীক্ষ্ণ মনীষার প্রভাব। ট্রেনে আসার সময় তিনি অনেক কথাই বলেছেন, কিছু অনুযোগও করেছেন। দুঃখ করে বলেছেন, চরিত্র রূপায়নের জন্য যে ধ্যান ও ধারণার প্রয়োজন তা অনেক অভিনেতা স্বীকার করেন না। তিনি আরো বলেছেন বাচনভঙ্গির প্রয়োজনীয়তার কথা। আবৃত্তি করার অভ্যাস থাকা সকলেরই উচিৎ। প্রত্যহ যদি কোন অভিনেতা রবীন্দ্রকাব্যের একপৃষ্ঠা করে' আবৃত্তি করেন তবে তাতে অভিনেতার বাণীশুদ্ধি ত হবেই এবং সেই সঙ্গে কবিগুরুর ভাব তরঙ্গিত অপূর্ব শব্দঝঙ্কার, ভাবব্যঞ্জনায় যথেষ্ট সাহায্য করবে। "প্রফুল্ল" নাটক অভিনয়ের প্রাক্ কালে তাঁকে পরিষদের পক্ষ থেকে যে "অভিনন্দন পত্র" দেওয়া হয়েছিল তার উত্তরে তিনি এক হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দেন। নাট্য সাহিত্যের মধ্যে সমস্ত রস উজাড় করে দেওয়ার ও গ্রহণ করার যে সুযোগ আছে এই কথাতে তিনি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের নাট্যশাস্ত্রের বহু কথাই সেদিন উল্লেখ করেছিলেন; এবং সবার অনুরোধে তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আবৃতিও করেন।



মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদের সাহায্যকল্পে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর অভিনয়পুষ্ট 'প্রফুল্ল' নাট্যাভিনয় সেদিন অর্থাৎ ২০ শে মাঘ ১৩৬০ ইং ৩/২/৫৪ তাং যে উন্মাদনা জাগিয়েছিল, এই পরিষদের ইতিহাসে তা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নাট্যাচার্য করেছিলেন যোগেশের ভূমিকা। পরিষদের প্রবীনদের মধ্যে ছিলেন,- মন্মথনাথ দাস (রমেশ), প্রভাতচন্দ্র মাইতি (কাঙ্গালীচরণ) জহরলাল অধিকারী (পীতাম্বর) দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (উমাসুন্দরী) সুধাময় বন্দোপাধ্যায় (পথিক)। নবীদের মধ্যে ছিলেন,- কালীকিঙ্কর পাল (শিবনাথ) ফনিভূষণ সেন (ভজহরি) অজিত বন্দোপাধ্যায় (সুরেশ) পূর্ণেন্দু মাইতি (মদন) আশুতোষ সরকার (জ্ঞানদা) তারাপদ গুপ্ত (জগমণি) সতীরঞ্জন দত্ত (প্রফুল্ল) কুমারী হাসি বন্দোপাধ্যায় (যাদব) এতদ্বাতীত রাম বন্দোপাধ্যায়, প্রশান্ত বন্দোপাধ্যায়, ডঃ উষানাথ সেনগুপ্ত, মনি দত্ত, সুরেন্দ্রমোহন দে, চন্দ্রশেখর কর্ম্মকার, অমিয়ময় দাস, মাখন ভট্টাচার্য্য, তারক মুখোপাধ্যায় প্রমূখ এই নাটকে অংশ গ্রহণ করেন। দৃশ্যসজ্জা প্রভৃতি ব্যবস্থাপনায় ছিলেন শ্রীযুক্ত বঙ্কিমবিহারী পাল (গুজিবাবু)। নাট্যাচার্য শিশির কুমারের সহচর্য্যে এই নবীন ও প্রবীণদের এই নাট্যানুষ্ঠান, পরিষদের বিশেষ ইপ্সিত ফললাভে আশানুরূপ সাহায্য করেনি বটে কিন্তু অন্তরের সম্পদে পরিষদ হয়েছিল সমৃদ্ধ। মন্মথ বাবু অসুস্থ শরীর নিয়েও সেদিন যখন আনন্দের উৎসাহে অভিনয়ে যোগ দিলেন, আমরা মনে মনে ভয় পেয়েছি, হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কায়। তারাপদ গুপ্তের 'জগমণি' ও দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'উমাসুন্দরী' অপূর্ব্ব অভিনয় অভিব্যক্তি। শিশির কুমার সেদিন বলেছিলেন 'ভালই হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বেটাছেলেত!' নাট্যাচার্য ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বল দীপ্তি অনেকের অন্তরে দেদীপ্যমান। প্রত্যেক শিল্পী ও স্রষ্টা তাঁদের কীর্তি ও রচনার মধ্যেই আত্মপরিচয় রেখে যান। পরিষদের প্রতি তাঁদের আন্তরিকতার পরিচয় তাই চির স্মরণীয়।


পরিশেষে বলি, মেদিনীপুর ও নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ী সম্পর্কিত বহু তথ্য বিভিন্ন পুরাতন পত্র-পত্রিকা বা বইতে একসময় প্রকাশিত হয়েছিল। সেইসব পুরাতন পত্র-পত্রিকা হয়তো এখনো অনাদরে-অবহেলায় কোথায় পড়ে রয়েছে। যদি আপনি এই বিষয় বা মেদিনীপুর সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ের তথ্যের খোঁজ পান, অনুগ্রহ করে জানাবেন।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

Published on 30.06.2025



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।