সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha

বর্ণময়ী সুবর্ণরেখা

Subarnarekha River - Jharkhand, West Bengal & Odisha.

সুদর্শন নন্দী।


মিষ্টি নাম সুবর্ণরেখা উচ্চারণ করলেই বাঙালি হিসেবে প্রথমেই মাথায় আসে প্রখ্যাত চলচিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের যুগান্তকারী সিনেমা সুবর্ণরেখার কথা। আর সিনেমার খেই ধরে অবশ্যই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বর্ণময়ী নদী সুবর্ণরেখা । এই প্রতিবেদন সিনেমার কথা নয়, নদী সুবর্ণরেখার পথ ধরে উৎস থেকে মোহনায় পৌঁছনর বিবরণ। সুবর্ণরেখার সেই বিবরণের সাথে জড়িয়ে রয়েছে তিনটি রাজ্যের মানুষের জীবনযাত্রা, আবেগ, ভালোবাসা। রয়েছে আমাদের মেদিনীপুরও। জড়িয়ে রয়েছে মহাভারতের পাণ্ডবেরাও।

সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha
প্রখ্যাত চলচিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের যুগান্তকারী সিনেমা সুবর্ণরেখার কথা।

সুবর্ণরেখা নামটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মূল্যবান সোনার কথা। সাধারণ মানুষ মনে করেন এই নদী দিয়ে জলের সঙ্গে সোনাও বয়ে চলে। সোনা বলতে তার টুকরো বা বালুকা দানা। সুবর্ণরেখা নদীর উৎপত্তি ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচির পিস্কা গ্রাম থেকে। এক সময় এই পিস্কা গ্রামে সোনার খনি ছিল। সোনার খনি সন্নিহিত নদী বলেই এই নদীর নাম সুবর্ণরেখা। খনি থেকেই সোনার কণিকা নদীতে মিশে যায়।বর্ষার পর সুবর্ণরেখায় জল কমে গেলে তীরে সোনার টুকরো পড়ে থাকে বলে স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস। আজও দেখা যায় স্থানীয় মানুষেরা বালি থেকে সোনা খুঁজতে থাকেন। শুধু সুবর্ণরেখাই নয়, তার উপনদী খারকাই নদী যা কিনা জামশেদপুরের আদিত্যপুরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে সেই নদীতেও নাকি সোনা পাওয়া যায়।

পিস্কাতে শুরু হয়ে সুবর্ণরেখা কিছুদুর গিয়ে আঁটকে পড়েছে গেতুলসুদ ড্যামে। গেতুলসুদ ড্যামটি সুবর্ণরেখার উৎস থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাঁচি থেকে ড্যামের দূরত্ব চল্লিশ কিলোমিটার। সুবর্ণরেখার জলে ১১৬ ফুট উঁচু এই ড্যামটি তৈরি হয় ১৯৭১ সালে। রাঁচি সহ বিস্তীর্ণ এলাকার পানীয় জলের উৎস এই গেতুলসুদ ড্যাম। ড্যাম থেকে বেরিয়ে পথে হুড্রু ফলসে ৯৮ মিটার নিচে পড়েছে সুবর্ণরেখা। তারপর জামশেদপুর, চাণ্ডিল, ঘাটশিলা, গোপীবল্লভপুর, ভসরাঘাট,গরদপুর, সোনাকনিয়া হয়ে উড়িষ্যায় ঢুকে জলেশ্বরের পাশ দিয়ে তালসারি মোহনায় পড়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। সুবর্ণরেখার মোট দৈর্ঘ্য ৩৯৫ কিলোমিটার। উপরোক্ত গেতুলসুদ ড্যাম ছাড়াও সুবর্ণরেখার জলে গড়ে উঠেছে চাণ্ডিল ড্যাম এবং ঘাটশিলায় গালুডি ব্যারেজ। এ রাজ্যেও কেশিয়াড়ির কাছে ভসরাঘাটে ব্যারেজ হবার কথা থাকলেও হয়ে ওঠেনি।

সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha
সুবর্ণরেখা নদীর উপরে গালুডি বাঁধ (ছবিঃ সুদর্শন নন্দী)।

এতো গেল সুবর্ণরেখার উৎস থেকে মোহনায় গমনের পথকাহন, কিন্তু নদীর এই সারা পথটিতে ছড়িয়ে রয়েছে শুধু সৌন্দর্য। আর সেই সৌন্দর্যের টানে মানুষ ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে। সে টান একেবারে উৎসমুখ থেকে। দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে গেতুলসুদ ড্যাম, বিখ্যাত হুড্রু ফলস। সেখান থেকে পাথর ঘেঁষে বেরিয়ে পাড়ি দিয়েছে চাণ্ডিলে। সেই চাণ্ডিল ড্যামের সৌন্দর্যও অসাধারণ। এরপর ঘাটশিলায় তার অপরূপ রূপ যেন চুইয়ে পড়ছে। ঘাটশিলা থেকে সে গোপীবল্লভপুর, হাতিবাড়ি, দেউলবাড়, ভসরাঘাট, সোনাকোনিয়া হয়ে ঢুকেছে উড়িষ্যায়।আলোচ্য প্রতিটি স্থানই পর্যটকদের কাছে প্রিয়স্থান। জায়গায় জায়গায় নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন আবাসও। তা সেই গোপীবল্লভপুরের কাছে কুঠিঘাট হোক, বা হাতিবাড়ি হোক বা খোদ গোপীবল্লভপুর হোক। শুধু তাই নয়, সুবর্ণরেখার তীরের জনপদগুলি বেঁচে রয়েছে এই নদীর জলকে সম্বল করে। সেচের জল, পানীয় জল, বিদ্যুৎ উৎপন্ন, ঘাটশিলা সন্নিহিত কলকারখানা সবাইকে সুবর্ণরেখা দুহাত ভরে তুলে দিয়েছে তার আয়নার মতো স্বচ্ছ জল। কতো সংস্কৃতি, উৎসব, মেলা এই সুবর্ণরেখাকে কেন্দ্র করেই। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মকর উৎসবের মূল নদী এই সুবর্ণরেখা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার সীমানায় বিশাল এলাকা জুড়ে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সুবর্ণরেখার তীরে বসে বালিযাত্রা মেলা।

সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha
সুবর্ণরেখা নদীর উপরে হুণ্ড্রু জলপ্রপাত।

খুব সাধারণ উপকরণ। ছাতু। সেটাই উৎসর্গ করা হয় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে। দলে দলে লোক এসে উপস্থিত হন সুবর্ণরেখার তীরে। পিতৃপুরুষকে স্মরণের এই রীতি উপলক্ষে নদীর তীরে বসে মেলাও। এই রীতি বালিযাত্রা নামে পরিচিত।

লোকসংস্কৃতির গবেষক মধুপ দে’র লেখা থেকে জানা যায়, বালিযাত্রা মেলা শুধু সুবর্ণরেখা নদীর তীরেই অনুষ্ঠিত হয়। সুবর্ণরেখা নদী পশ্চিমে যেখানে ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলায় ঢুকেছে সেখানে করবনিয়া গ্রামের কাছে মূল বালিযাত্রা মেলাটি বসে। কিন্তু, সুবর্ণরেখা নদী পূর্বে যেখানে বাংলা থেকে ওড়িশায় ঢুকেছে সেই সব স্থান থেকে ৬০-৬২ কিলোমিটার দূরে করবনিয়ার মূল বালিযাত্রার স্থানে সকলে আসতে পারেন না বলে নদীর তীরে নানা স্থানে ছোট ছোট বালিযাত্রা মেলা হয়। দাঁতনের গরদপুর, সোনাকানিয়া এবং বেলমূলাতে, কেশিয়াড়ির ভসরাঘাটে এবং ওড়িশার জলেশ্বরের রাজঘাট ও মাকড়িয়ায় সুবর্ণরেখা নদীর তীরে চৈত্র সংক্রান্তির দিনেই বালিযাত্রা মেলা বসে।

সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha
সুবর্ণরেখা নদীর উপরে গেতুলসুদ ড্যাম (ছবিঃ সুদর্শন নন্দী)।

বালিযাত্রা তথা সুবর্ণরেখা নদীর সাথে মহাভারতের যোগ রয়েছে বলে লোকবিশ্বাস। বিশ্বাস অনুযায়ী পাণ্ডবেরা বারো বছর বনবাস কাটিয়ে অজ্ঞাতবাসের জন্য এসেছিলেন ‘সোনারেখা’ বা সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। সেটি ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার গভীর অরণ্যে। অজ্ঞাতবাসের শেষে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে যুধিষ্ঠির বাৎসরিক পিতৃশ্রাদ্ধের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু, তার জন্য প্রয়োজন উত্তরবাহিনী গঙ্গা। তিনি তখন সুবর্ণরেখার অববাহিকা অঞ্চলে বাস করেন। সাহায্যে এগিয়ে এলেন অর্জুন। তিনি মাটিতে তির ছুড়লে মাটির নীচ থেকে মন্দাকিনীর ধারা এসে মিলিত হল সুবর্ণরেখায়। সুবর্ণরেখা হয়ে গেল উত্তরবাহিনী গঙ্গা। যুধিষ্ঠির নদীর তীরে বালির চরে বসে ছাতু দিয়ে পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন। স্থানীয় বিশ্বাস, আজও এই অঞ্চলে সুবর্ণরেখা নদীর উভয় তীরে পাণ্ডবদের পিতৃশ্রাদ্ধের স্মরণে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয় বালিযাত্রা মেলা। এসময় সুবর্ণরেখার তীর হয়ে ওঠে আদিবাসী-অআদিবাসী সকল মানুষেরই মিলন মেলা।

সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha
সুবর্ণরেখা নদীর সাথে কাঞ্চি নদী মিশে যাওয়ার আগে কাঞ্চি নদীর উপরে দশম জলপ্রপাত।

সত্যি বলতে কি, সুবর্ণরেখা তিন রাজ্যের মানুষের কাছে শুধু একটি নদীই নয়, সুবর্ণরেখা তাদের কাছে সোনার জীবনরেখা। অন্যদিকে, তার বিস্তৃত সোনালি বালুকাভুমির জন্য, অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য পর্যটনপ্রিয় মানুষদের কাছে সুবর্ণরেখা হয়ে উঠেছে নয়নের মণি। আর সুবর্ণরেখা মেদিনীপুরকেও ব্রাত্য করে নি। জেলার এক অংশকে আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়েছে তাঁর সোনালী বাহুবন্ধে।

সুবর্ণরেখা, Subarnarekha, River, Jharkhand, West Bengal, Odisha
গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখা নদী (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক)।


midnapore.in

(Published on 09.05.2021)