Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार

তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার

Tamralipta Jatiya Sarkar | ताम्रलिप्त जातीय सरकार

(December 17, 1942 - August 8, 1944)

অরিন্দম ভৌমিক।


১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীন জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সরকারগুলির মধ্যে প্রাতি সরকার (সাতারা, মহারাষ্ট্র) সব থেকে বেশি দিন চললেও মেদিনীপুর জেলার "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার" ছিল সবথেকে সংগঠিত ও সফল। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রসঙ্গে আসার আগে আমরা অন্যান্য সরকারগুলির সম্পর্কে সংক্ষেপে দেখে নেব। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট। ঠিক তার ১০ দিন পর ১৯ আগস্ট উত্তরপ্রদেশে গঠিত হয় প্রথম জাতীয় সরকার।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
জাতীয় সরকার (বাল্লিয়া, উত্তরপ্রদেশ)

জাতীয় সরকার (বাল্লিয়া, উত্তরপ্রদেশ)

উত্তরপ্রদেশের বাল্লিয়া জেলায় ১৯৪২ সালের ১৯ আগস্ট মাসে চিতু পাণ্ডে -র নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠিত হয়। চিতু পাণ্ডে ছিলেন এই সরকারের স্বরাজ তহসিলদার। সমস্ত বন্দি কংগ্রেস নেতাদের মুক্ত করেন। এক সপ্তাহ চলেছিল।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
Nana Patil in a photo from the 1940s with Col. Jagannathrao Bhosle (in uniform) of the ‘Azad Hind Sena’ (a force inspired by Netaji Subash Chandra Bose). Credit: People’s Archive of Rural India.

প্রাতি সরকার (সাতারা, মহারাষ্ট্র)

১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে নানা পাতিল -এর নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রাতি সরকার। মহারাষ্ট্রের সাতারা-সাংলি অঞ্চলে ১৫০ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এই সরকার সব থেকে বেশি দিন চলেছিল। অন্যান্য নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বি.জি. পাতিল , ওয়াই. বি. চাভান। এই সরকারের ন্যায়দান মণ্ডল (People's court) ছিল এবং ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত চলেছিল।



মজদুর রাজ, চাষী মাউলিয়া (তালচের, ওড়িশা)

১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট সমস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। গঠিত হয় জাতীয় সরকার যার নাম ছিল মজদুর রাজ বা চাষী মাউলিয়া। অসংখ্য বিপ্লবী পদযাত্রা করে তালচের শহরে গেলে ব্রিটিশ বাহিনী মেশিনগান দিয়ে হত্যালীলা চালায়।

স্বাধীন বাঞ্ছনিধি চাকলা (এরান-বাসুদেবপুর, ওড়িশা)

১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওড়িশার এরান-বাসুদেবপুরে গঠিত হয় 'স্বাধীন বাঞ্ছনিধি চাকলা' (জাতীয়তাবাদী কবি বাঞ্ছনিধি মহান্তির নামে)। ৬ টি পঞ্চায়েত ও ২৪ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গৌরাঙ্গ চন্দ্র মহান্তি এবং রমলা প্রাসাদ কর ছিলেন কমান্ডার-ইন-চিফ।

গুড়পাল, বালেশ্বর

১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওড়িশার বালেশ্বের জেলার গুড়পালেও চেষ্টা হয়েছিল একটি স্বাধীন সরকার গঠনের।

আজাদ দাস্তান (উত্তর ভাগলপুর, বিহার)

১৯৪২ জয়প্রকাশ নারায়ণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর জন্য নেপালের তরাই অঞ্চলে (বাকরো কা তাপু) তৈরী করেন 'সর্বভারতীয় আজাদ দাস্তান' এবং 'বিহার আঞ্চলিক আজাদ দাস্তান'। 'আজাদ দাস্তান' -এর সবথেকে সক্রিয় শাখা ছিল বিহারের উত্তর ভাগলপুর। তিলকপুর গ্রামের সিয়ারাম সিং -এর নেতৃত্বে উত্তর ভাগলপুরে'র সুলতানপুরে 'আজাদ দাস্তান' সরকারের ঘোষণা করা হয়। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি পরিচালনা করত স্বতন্ত্র মণ্ডল এবং এর উপরে ছিল থানা পঞ্চায়েত। স্বতন্ত্র মণ্ডলের চারটি ভাগ ছিল - ১) স্থানচ্যুতদের জন্য ২) প্রচার ৩) গ্রাম প্রতিরক্ষা ৪) সেবক দল। প্রত্যেক বিভাগের প্রধানকে আদলিয়াক্ষা (Adliyaksha) বলা হত। আদলিয়াক্ষার কথামত চলত সেবক দল। এছাড়াও বিহারে সেই সময় সিয়ারাম দল ও পরশুরাম দল নামে দুটি বিপ্লবী দল সক্রিয় ছিল।

"তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার"

এবারে আসা যাক "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার" প্রসঙ্গে। এই সরকারকে বহু চেষ্টা করেও ইংরেজরা উচ্ছেদ করতে পারেনি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গান্ধীজীর আহবানে, চতুর্থ সর্বাধিনায়ক বরদা কান্ত কুইতি ১৯৪৪ সালের ৮ আগস্ট এই সরকার বন্ধের আদেশ দেন। ১৯৪২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর তমলুক মহকুমায় "তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠিত হয়। সিদ্ধান্ত ছিল যে ভবিষ্যতে যখন ভারতবর্ষে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠবে তখন এই জাতীয় সরকার তার যোগদান করবে। জাতীয় সরকার গঠনের সময় যে উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, তা ছিল -


১. এই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে'র অংশরূপে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে এই মহকুমা এলাকার জনগণের আশা-আকাঙক্ষা পূরণ করবে।

২. যদি জাপান ভারত আক্রমণ করে, তবে এই সরকার যথাসাদ্ধ তার মোকাবিলা করবে এবং ভারতে প্রবেশ করলে তাকে এই স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করবে।

৩. সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান এবং তার আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতীয়দের মনে যে আশার সঞ্চার করেছে, যদি তিনি বাহিনী সহ ভারতে আসেন, তবে তাকে স্বাগত জানাবে এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতা করবে।


এই সরকার প্রতিষ্ঠার দুইটি প্রধান দিক ছিল -

প্রথমত, মহকুমাবাসীদের দুঃখমোচন, শাস্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, ইংরেজশাসকদের সহযোগী দেশবাসীর শাস্তিবিধান এবং ইংরেজশাসনকে পঙ্গু করা। দ্বিতীয়ত, আপসহীন সংগ্রামের নির্ভিক নায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর জার্মানী ও তার মিত্রদের সাহায্য লাভ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতালাভের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করা।

তান্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের গঠন ও পরিচালন -


১) একজন সর্বাধিনায়ক থাকবেন ।

২) কয়েকটি বিভাগ থাকবে এবং প্রত্যেকটি বিভাগের ভার থাকবে একজন “সচিব' -এর উপর।

৩) বিভাগগুলি হল - আইনশৃঙ্খলা, সাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার, কৃষি, প্রচার, প্রতিরক্ষা, অর্থ।


সেই সময়ে কোনরকম নির্বাচন করা সম্ভব ছিল না। আলোচনার পরে কংগ্রেস কমিটি একজন সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেন। কংগ্রেস কমিটির দ্বারা নির্দেশিত কার্যক্ষেত্রে কাজ করার অবাধ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সর্বাধিনায়ক। কংগ্রেস কমিটিই সাধারণ কার্যক্রম নির্ধারণ করে দিতেন। সর্বাধিনায়ক সেইমত কাজ করতেন। সর্বাধিনায়ক বিভাগীয় মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারতেন, তবে তা মহকুমা কংগ্রেস কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষ ছিল। তিনি অন্যান্য মন্ত্রীদের সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন থানার কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি “পরামর্শ পরিষদ" গঠিত হয়।



মেদিনীপুর জেলার বিশিষ্ট কংগ্রেস-নেতা সতীশচন্দ্র সামন্ত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রথম সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। সর্বাধিনায়কের হাতে ছিল পররাষ্ট্র দপ্তর। অর্থসচিব হলেন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র সচিব হলেন সুশীলকুমার ধাড়া।

পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৩ সালের ২৬শে জানুয়ারী 'থানা জাতীয় সরকার' স্থাপিত হল। থানাগুলি যথাক্রমে - সুতাহাটা, নন্দীগ্রাম, মহিষাদল ও তমলুক। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের পরিচালনাধীনেই এগুলি স্থাপিত হয়। এই জাতীয় সরকার গুলিতেও একজন অধিনায়ক ও কয়েকজন সচিব ছিলেন। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর মহকুমা সরকারের মত অন্যান্য বিভাগও থানা জাতীয় সরকারে রইল। মহিষাদলে প্রথম অধিনায়ক হলেন নীলমণি হাঁজরা। তিনি জেলে গেলে অধিনায়ক হলেন বরদাকান্ত কুইতি। নন্দীগ্রামে অধিনায়ক হলেন কুঞ্জবিহারী ভক্ত। তমলুকে অধিনায়ক হলেন গুণধর ভৌমিক, প্রিয়নাথ জানা এবং পরে ডঃ প্রফুল্ল কুমার বসু ও অমূল্যচরণ মাইতি। সুতাহাটায় অধিনায়ক হলেন জনার্দন হাজরা এবং পরে রাসবিহারী জানা ও দেবেন্দ্রনাথ কর।

বিদ্যুৎবাহিনী (জাতীয় সৈন্যবাহিনী)

থানা জাতীয় সরকার গঠনের দিনই সর্বাধিনায়কের এক ঘোষণায় “বিদ্যুৎবাহিনী” কে জাতীয় সেনাবাহিনী হিসাবে গ্রহণ করা হল। এর একজন সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হলেন, যাকে বলা হল কমান্ডার-ইন-চিফ। সুশীলকুমার ধাড়া এই জাতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিষুক্ত হলেন। জাতীয় সরকার বিদ্যুৎবাহিনীকে যখন জাতীয় সৈন্যবাহিনীরূপে গ্রহণ করে, তখন আরও তিনটি নতুন শাখা খোলা হল -


১) গেরিলা বিভাগ।

২) ভগিনীসেনা বিভাগ।

৩) আইনশৃঙ্খলা বিভাগ।


বিদ্যুৎবাহিনীর প্রথমে যে তিনটি বিভাগ ছিল, তা হল -


১) যুদ্ধ বিভাগ

২) গোয়েন্দা বিভাগ

৩) সেবা-শুশ্রষা বিভাগ


“ভগিনীসেনা” বিভাগ খোলার ফলে পরবর্তী নামকরণ হয় - “বিদ্যুৎবাহিনী ও ভগিনীসেনা”। থানা এবং মহকুমার ক্ষেত্রে বিভাগীয় সচিবরা সম্পূর্ণ অধিনায়কের নির্দেশে চলতেন এবং পারস্পরিক সম্মিলিত দায়িত্বে ও সহযোগিতায় কাজ করতেন। মূল লক্ষ্য ছিল, জনগণের প্রয়োজনকে রূপ দেওয়া ও জাতীয় সরকারের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করা ।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
“ভগিনীসেনা” বিভাগ খোলার ফলে পরবর্তী নামকরণ হয় - “বিদ্যুৎবাহিনী ও ভগিনীসেনা”

“বিদ্যুৎবাহিনী” কে জাতীয় সেনাবাহিনী হিসাবে গ্রহণ করার ঘোষণা - "বিদেশী শত্রুর সহিত (ইংরেজশাসন) সংগ্রাম করিবার জন্য এবং দেশের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করিয়া স্বাধীন তমলুকে গণতান্ত্রিক সুশাসন চালাইবার জন্য শুভ ১লা পৌষ, ১৩৪৯ হইতে যে “তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার” প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং তাহারই অঙ্গ স্বরূপ থানায় থানায় যে থানা জাতীয় সরকারগুলি ভারতীয় স্বাধীনতা দিবসে শুভদিনে (২৬শে জানুয়ারী, ১৯৪৩; ১২ মাঘ, ১৩৪৯) শুরু করা হইয়াছে - তাহাদের সফলতার মূলে ছিল তমলুক মহকুমাবাসীদের সাহস, বীরত্ব ও আত্মত্যাগ। এই বীরবৃন্দকে সংঘবদ্ধ করিয়া শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত করিয়াছিল মহকুমার সুশিক্ষিত কর্মীগণ। এই দেশসেবকদলের অগ্রণী ছিল “বিদ্যুৎবাহিনী”। আজ এই স্বাধীনতা দিবসে (২৬শে জানুয়ারী, ১৯৪৩) সেই “বিদ্যুৎবাহিনী" কে সমগ্র মহকুমায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের "জাতীয় সৈন্যবাহিনী” বলিয়া গ্রহণ করা হইল।


তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের কার্যাবলী


আইন শৃঙ্খলা বিভাগ

মূলত শাস্তি রক্ষার দায়িত্ব ছিল এই বিভাগের উপর। সাধারণত গুপ্তচরদের মাধ্যমে খোঁজখবর সংগ্রহ করা হ'ত। বহু চোর ও ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। ইংরেজ সরকারের উৎসাহ ও প্ররোচনায় এইসব চোর-ডাকাতরা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করত। এদের হাত থেকে জনগণের নিরাপত্তার জন্য জাতীয় সরকার কঠোর হাতে এদের দমনের দায়িত্বভার তুলে নেয় এবং যথেষ্ট সফল হয়। অরাজকতা সৃষ্টিকারী এইসব চোর-ডাকাতদের গ্রেপ্তার করে জাতীয় সরকারের আদালতে হাজির করে কঠোর শাস্তিদানের ফলে দেশে শান্তি অব্যাহত ছিল।



স্বাস্থ্য বিভাগ

দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিরোধ করতে এই বিভাগ কাজ করেছিল। পোশাক-পরিচ্ছদ, অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ করে দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে বিতরণ করত। দরিদ্র ব্যক্তিরা যাতে করে ধনী মজুতদার ও মুনাফাখোরদের দ্বারা শোষিত না হয় তার দিকে জাতীয় সরকারের এই বিভাগ যেমন সতর্ক করিয়ে দিত তেমনি তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা ও ধান সংগ্রহ করে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করত। ওষুধপত্রও বিতরণ করার দায়িত্ব ছিল এই বিভাগের । মোট ৭৯,০০০ টাকা মূল্যের পোশাক, ওধধ, ধান ও চাল বিতরণ করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ত্রাণকার্য সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য মহকুমার কংগ্রেস কর্মীগণ প্রয়াত নিষ্ঠাবান নেতা মহেন্দ্রনাথ মাইতির স্মরণে (মৃত্যু ১৯৪০ স্রীষ্টাব্দের ৬ই জুন) “মহেন্দ্র রিলিফ কমিটি” গঠন করেন।

মহেন্দ্র রিলিফ কমিটি

এই কমিটির মুখ্য পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নেতৃস্থানীয় কংগ্রেসকর্মী অনঙ্গমোহন দাস ও প্রহ্লাদকুমার প্রামাণিক। এই মহকুমায় বেঙ্গল রিলিফ কমিটির প্রায় সব কাজকর্মই মহেন্দ্র রিলিফ কমিটির মারফৎ পরিচালিত হত। আরও লক্ষণীয় এই যে, পঞ্চাশের মন্বত্তরের সময় ষেসব সেবা প্রতিষ্ঠান তমলুক মহকুমায় পরিচালনা করত। জাতীয় সরকারের কাজকর্ম স্থগিত রাখার পরেও এই রিলিফ কমিটি দুর্ভিক্ষজনিত রোগ-শোক এবং অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের কাজ করে যেতে থাকে। কলকাতা থেকে বেঙ্গল রিলিফ কমিটির তৎকালীন কর্মী কৃষ্ণচৈতন্য মহাপাত্র এই কমিটিকে সাধ্যমত সাহায্য করার চেস্টা করেন। মহেন্দ্র রিলিফ কমিটি বিভিন্ন অঞ্চলে যে সব সাহায্যকেন্দ্র বা চিকিৎসাকেন্দ্র খুলেছিল সেগুলির পরিচালনার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় কংগ্রেস-কর্মীদের উ পর। মহকুমার চিকিৎসাকেন্দ্রগুলি সুষ্ঠভাবে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রাসবিহারী মিশ্র। বলা বাহুল্য, এইসব কংগ্রেস-কর্মীরা আত্মগোপন করেই কাজকর্ম করতেন।

শিক্ষা বিভাগ

এই বিভাগের কাজ ছিল নিয়মিতভাবে জাতীয় বিদ্যালয়গুলিকে নিয়মিত আর্থিক অনুদান দেওয়া। যোগ্য পরিদর্শক পাঠিয়ে নিয়মিত বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন করা হ'ত। স্কুলের এবং ছাত্রদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়মিত শুনে সমাধান করা হত।

বিচার বিভাগ

প্রতি থানায় একটি করে বিচার বিভাগ ছিল। বিচারালয়গুলি ছিল ভ্রাম্যমান। জনসাধারণের সুবিধার জন্য এ ব্যবস্থা চালু হয়। বিচার চলাকালীন জনসাধারণ উপস্থিত থাকতে পারত। জাতীয় সরকারের বিচার বিভাগ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিচার প্রার্থীদের নির্দিষ্ট ফি দিয়ে মামলা দায়ের করতে হ'ত। প্রথমে এক টাকা পরে দু-টাকা ফি ধার্য করা হয়। ফৌজদারী ও দেওয়ানী উভয় মামলারই বিচার করা হত। থানার বিচারালয়ের রায়ের বিরুদ্ধে মহকুমা ভিত্তিতে জাতীয় সরকারের যে বিচারালয় ছিল সেখানে আপীল করা যেত। এমনকি মহকুমা বিচারালয়ের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ দেওয় হত। এই ধরণের বিচার তিনজন বিচারককে নিয়ে এক বিশেষ ট্রাইবুন্যাল-এ করা হত।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

মহকুমা বা জেলা আদালতগুলিতে এমনকি হাইকোর্টে অনেকদিন ধরে যেসব মামলা চলছিল, সেগুলি সন্তোষজনকভাবে জাতীয় সরকারের আদালতে নিষ্পত্তি হয়। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী সতর্কীকরণ, অর্থদণ্ড, আদালতের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক প্রভৃতি দণ্ডদানের রীতি ছিল। ফেরারী আসামীর সম্পত্তি ক্রোক করা হত। অধিকাংশ মামলাতেই আপস মীমাংসা ঘটত। উপস্থিত মামলার সংখ্যাধিক্য থেকে বোঝা যায় বিচার ব্যাবস্থার জনপ্রিয়তা। জাতীয় সরকারের আদালতে সুতাহাটায় ৮৩৬ টি মামলা, নন্দীগ্রামে ২২২ টি মামলা, মহিষাদলে ১০৫৫ টি মামলা এবং তমলুকে ৭৯৪ টি মামলা রুজু হয়েছিল। মোট মামলা রুজুর সংখ্যা ২৯০৭ টি; তার মধ্যে ১৬৮১ টি মামলার বিচার করা হয়েছিল। কয়েকটি মামলা আপীলের জন্য মহকুমা জাতীয় সরকারের বিচারালয়ে ও বিশেষ ট্রাইবুন্যালের সম্মুখে উত্থাপিত করা হয়েছিল। জাতীয় সরকার ভেঙে দেওয়ার পরও যেসব মামলা বিচারাধীন ছিল, তাদের মামলা রুজুর জন্য যে ফি জমা দিয়েছিল, তা ফেরৎ দেওয়া হয়। জাতীয় সরকারের বিচার বিভাগ এতই জনপ্রিয় ছিল যে, বিচারাধীন মামলাগুলি যারা রুজু করেছিল, তারা ফি ফেরৎ নিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমত প্রকাশ করে এবং তারা চেয়েছিল যেন তাদের মামলাগুলি জাতীয় সরকারের বিচারালয়েই নিস্পত্তি হয়। কিছু কিছু ভূমি হস্তান্তরের কাজ অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন-এর কাজ হত। এ বিভাগের কাজ এত সুষ্ঠভাবে করা হয়েছিল যে, পরবর্তীকালে সে রায়কে ইংরেজ সরকার স্বীকৃতি জানিয়েছিল। সম্মানের সঙ্গে মহকুমা বিচারকরা (মহকুমা শাসক, মুন্সেফ ইত্যাদি) তা পরে মেনে নিয়েছিলেন।



প্রতি থানায় যেসব সংগ্রাম-শিবির ছিল সেইসব শিবির এলাকায় বিচারসচিব গিয়ে সেই এলাকার বিচারগুলি করতেন। এ বিচারালয় বসত কোন লোকের বাড়ীতে, নিরাপদ স্থানে। কখনো দিনে, কখনো রাতে সে বিচার হত। বিচারালয় যে স্থানে বসত, তার চারদিকের রাস্তায় থাকত সতর্ক পাহারা, যাতে কোনভাবে পুলিশবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করতে না পারে। প্রতি থানা জাতীয় সরকারের অধীনে যেমন একজন “বিচারসচিব" ছিলেন তেমনি তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অধীনেও একজন বিচারসচিব ছিলেন। যার কাজ ছিল থানার বিচারসচিবের রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে কোন পক্ষ আপীল করলে থানা বিচারসচিবদের সঙ্গে বসে অথবা ট্রাইবুন্যাল গঠন করে সেই মামলাগুলির বিচার করা। থানার বিচারালয়গুলি ছিল ভ্রাম্যমান।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

বিচারবিভাগের কাজের ধারা ছিল নিম্নরূপ।

কোন অভিযোগ থাকলে প্রথমেই বিচারসচিবের আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে হত এবং আবেদনের সঙ্গে ২ টাকা ফী-ও জমা দিতে হত। সে টাকার রসিদও তারা সঙ্গে সঙ্গে পেত। পরে ফী করা হয়েছিল তিন টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে, বিচার সচিবের সাক্ষরে বিবাদীকে বাদীর জবাব দেওয়ার জন্য আবেদনের নকলসহ নোটীশ করা হত। তৃতীয় পর্যায়ে, বাদী-বিবাদী উপস্থিত হত। বিবাদীর জবাব শোনা হত। সে জবাব লিখিতভাবে বিবাদী দিত। উভয় পক্ষের কথা শোনার পর উভয় পক্ষকে একটি মীমাংসা বা আপসের সূত্রে আসতে বলা হ'ত। চতুর্থ পর্যায়ে, উভয়পক্ষ আপস করতে রাজী হলে লিখিতভাবে উভয়পক্ষ সাক্ষীর সাক্ষরসহ বিচারসচিবের কাছে জমা দিতেন। বিচারসচিব সেই আপসের মূলে লিখিত রায় প্রদান করতেন।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মীমাংসা হ'ত আপসমূলক বিচারে । জবরদস্তির প্রশ্ন থাকত না। সামান্য ক্ষেত্রে কোন পক্ষ আপস মীমাংসায় অসম্মত হ'লে যথাবিহিত রায় মেনে নিতে বাধ্য হত। কোন কোন ক্ষেত্রে বাদী বা বিবাদীর পক্ষে বুঝদার ব্যক্তি উপস্থিত থেকে তার পক্ষে কথা বলতেন। এমনকি কয়েকটি ক্ষেত্রে উকিলও উপস্থিত থেকেছেন। পঞ্চম পর্যায়ে ছিল, কোন পক্ষ রায়ে সন্তষ্ট হতে না পারলে তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপীল করতে পারত।

শেষ পর্যায়ে বা ষষ্ঠ পর্যায়ে ছিল, যদি আপীল যথাসময়ে না করত বা রায় মেনে না নিত, সে ক্ষেত্রে বাদী বা বিবাদী সে কথা জানালে বিচারসচিব রায় অমান্য করার জন্য মাল ক্রোকেরও নির্দেশ দিতেন। মাল ক্রোকের নির্দেশের নকল বিদ্যুৎবাহিনীর জি. ও. সি.-কে দিয়ে মাল ক্রোক করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলতেন। সেক্ষেত্রে জি. ও. সি. তাঁর বাহিনী নিয়ে মাল ক্রোক করতেন। মালের তালিকায় স্বাক্ষর করে গৃহকর্তীকে একটি নকল দিতেন এবং আর একটি নকলে মালিক বা মালিকপক্ষের স্বাক্ষর গ্রহণ করতেন। সাক্ষীর স্বাক্ষরও গ্রহণ করা হ'ত। অর্থাৎ আইনানুগ ও রীতিগত ব্যবস্থী গৃহীত হত। কোন পক্ষ আপীল করলে সেই মামলাটি তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের বিচারসচিব মামলার কাগজপত্র দেখে রায় দিতেন অথবা ট্রাইবুন্যাল গঠন করে বিচারের ব্যবস্থা করতেন।



উল্লেখযোগ্য হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউ কেউ সরকারী আদালতে পুরানো মামলার জের টেনে সরকারী কোর্টে মামলা করেছিল। সেক্ষেত্রে সরকারী কোর্টের বিচারক জাতীয় সরকারের বিচারের রায় দেখে তাতে একমত হয়ে সেই একইরকম রায় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে জাতীয় সরকারের বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতার স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। জাতীয় সরকারের বিচারালয়ে বিচারের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল মোট ২৯০৭টি মামলার। বিচার নিষ্পত্তি বা মীমাংসা হয়েছিল মোট ১৬৮১টি মামলার। ট্রাইবুন্যালে গিয়েছিল সামান্য মামলা । বিচার অমান্য করার জন্য ৩/৪টি ক্ষেত্রে মাত্র মাল ক্রোক করতে হয়েছিল। বিচার বিভাগের অধীনে অনেকগুলি জমি হস্তাস্তরের রেজিস্ট্রেশনও করা হয়েছিল। জাতীয় সরকারের বিচারের নিরপেক্ষ ও নির্ভুল রায়ের জন্য এর উপর সাধারণ মানুষ খুবই আস্থা ছিল।

কৃষি বিভাগ

এই বিভাগ কৃষি বিষয়ক সমস্ত ধরণের সমস্যার সমাধান করত।

প্রচার বিভাগ

দরকার মত বিভিন্ন ধরণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও প্রচার করত এই বিভাগ। এছাড়াও সমস্ত দপ্তরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত এই বিভাগ। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রচার বিভাগের সচিব শ্রী প্রহ্লাদকুমার প্রামাণিক জাতীয় সরকার প্রসঙ্গে বলেছেন - "জনসাধারণ এই সরকারকেই প্রকৃত সরকার বলে মনে করত। ইংরেজ সরকারের অস্তিত্ব ছিল মানুষের কাছে একটি বিভীষিকাময় প্রেতের অস্তিত্বের মতো - যা অতীত, কিন্তু যার অনিষ্টসাধনের ক্ষমতা অপরিমেয়।”

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

প্রতিরক্ষা (সমর) বিভাগ

এই বিভাগের প্রধান কাজ ছিল ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত ধরণের ভুল কাজকে প্রতিরোধ করা। কিন্ত ঝড় ও দুর্ভিক্ষের ফলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বেড়ে গিয়েছিল এবং সরকারের ঔদাসীন্য ও ভ্রান্ত নীতির ফলে জনগণের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমর বিভাগ ত্রাণকার্যে অধিক গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়। ঝড় ও দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ নাগরিকদের সমস্ত ধরণের সাহায্য করে এই বিভাগ। স্বাস্থ্য জননিরাপত্তা বিভাগকেও এই কাজে নানা ভাবে সাহায্য করে এই বিভাগ।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

অর্থ দপ্তর

সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ ও বন্টন ছিল এই বিভাগের প্রধান কাজ।

স্বভাবতই এই সরকার জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাই জনসাধারণ একে নিজেদের সরকার বলে মনে করত। বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব যাঁদের উপর ছিল, তারা ছিলেন জনসেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ। জাতির প্রয়োজনেই সেদিন গড়ে উঠেছিল এই জাতীয় সরকার। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ১৯৪২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৪ সালের ৮ই আগষ্ট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। যদিও এই সরকারের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় ১৯৪৪ -এর ১লা সেপ্টেম্বর। এই সময়ের মধ্যে চারজন সর্বাধিনায়ক হন। ১৯৪৩-এর ২৬শে মে প্রথম সর্বাধিনায়ক শ্রী সতীশচন্দ্র সামন্ত ইংরেজদের হাতে বন্দী হলে দ্বিতীয় সর্বাধিনায়ক হন শ্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি ১৯৪৩ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর বন্দী হলে তৃতীয় সর্বাধিনায়ক হন শ্রী সতীশচন্দ্র সাহু। ১৯৪৪ সালের ১০ই মার্চ সত্যাগ্রহ অভিযান পরিচালনাকালে তিনি বন্দী হলে চতুর্থ সর্বাধিনায়ক হন শ্রী বরদাকান্ত কুইতি।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

এই সরকার সমস্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গান্ধীজীর আহ্বানে আপনা থেকেই আত্মসমর্পণ করেছিল। ইংরেজ সরকারের শক্তি বা দমননীতি তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারকে উচ্ছেদ করতে পারেনি।

১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে দেশব্যাপী হিংসাত্মক ঘটনাবলীর জন্য বড়লাট লর্ড লিনলিথগো গান্ধীজীকেই দায়ী করেন। গান্ধীজী প্রত্যুত্তরে বলেন, সরকারের হিংসাত্মক কাজই জনগণকে হিংসার পথে নামিয়েছে। গান্ধীজী অবশ্য দেশে হিংসাত্বক কাজের জন্য অত্যন্ত কাতর বোধ করলেন এবং ৯ই ফেব্রুয়ারী থেকে ২রা মার্চ (১৯৪৩) পর্যস্ত অনশন করলেন। এদিকে মিত্রপক্ষের জয়ের সম্ভাবনা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠায় কংগ্রেসের মনোভাবেরও কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেয়। কংগ্রেস যে তার সংগ্রামের নীতি পরিবর্তন করতে চলেছে, তা গান্ধীজীর ২৯শে জুলাই (১৯৪৪) এবং ৬ই আগষ্ট (১৯৪৪) তারিখে দেওয়া বিবৃতিগুলি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের নেতারাও তা বুঝতে পারেন এবং চতুর্থ সর্বাধিনায়ক শ্রী বরদাকান্ত কুইতি ৮ই আগস্ট (১৯৪৪) ঘোষণা করলেন, অবিলম্বে জাতীয় সরকার ভেঙে দেওয়া হোক। কিন্তু ঘোষণার পরদিনই তিনি গ্রেপ্তার হলেন। কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক শ্রী সুশীলকুমার ধাড়া এক বিবৃতিতে ১৯৪৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় সরকারের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেন। মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশানুসারে ২৯শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৫০ জন কংগ্রেস-কর্মী ইংরেজ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

বিয়াল্লিশের ভারতছাড়ো আন্দোলনের অংশরূপে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে তমলুকের জনগণ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রকাশিত “Some Facts About the Disturbances in India" পুস্তকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সাংগঠনিক দক্ষতার স্বীকৃতি পাওয়া যায় - “In Midnapore in Bengal the operations of the rebels indicated considerable care and planning; effective warning system had been devised, elementary tactical principles were observed, for instance encirclement and flanking movements clearly on pre-arranged signals. The forces of disorder were accompanied by doctors and nursing orderlies to attend the casualties and intelligence system was efficient.”

Tamralipta Jatiya Sarkar, Tamralipta National Government | তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার | ताम्रलिप्त जातीय सरकार
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সংগ্রহ ও ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

সামগ্রিকভাবে এই উক্তির মধ্য দিয়ে মেদিনীপুরের বিপ্লবের সাংগঠনিক দিকের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করলেও প্রধানত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের কাজকর্মের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ১৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯৪৪) তারিখে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মিঃ ফজলুল হক বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে প্রায় অনুরূপ কথাই বলেন - “Midnapore had parallel government with its military and police forces and intelligence branch; it had its jails where people were imprisoned; and in some cases, the people had actually paralysed the government.” ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মেদিনীপুরের (তমলুকের) জাতীয় সরকারের ভূমিকা যে কত বড় ছিল, তা উপরোক্ত মন্তব্যগুলি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়।


অরিন্দম ভৌমিক।

midnapore.in

(Published on 17.12.2020)

কৃতজ্ঞতা।

স্মৃতিসৌধ, নিমতৌড়ি।


তথ্যসূত্র।

১) তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার (সংগঠন ও পরিচালন ব্যবস্থা), গোপীনন্দন গোস্বামী।

২) তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, রাধাকৃষ্ণ বাড়ী।

৩) তমলুকের ইতিহাস, ডঃ প্রদ্যোত কুমার মাইতি।

৪) স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর।

৫) 1942-1947: From Quit India to Transfer of Power, Praveen Bansal, abhipedia.

৬) Quit India Movement, Somen Chakraborty, Employment News Weekly, Government of India.

৭) Militant Revolutionary Groups in Bhagalpur During the Quit India Movement, Amar Kant Singh, Manish Kumar.

৮) Tamralipta National Government, Garamdal, Banga Bhusan Bhakta

৯) বিপ্লবী, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।

১০) অজেয় পুরুষ অজয়কুমার।

১১) চির তরুণ বিপ্লবী সুশীলকুমার।

১২) Sarbadhinayak