খড়গপুরে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর বাড়ি
অর্ণব মিত্র।
Home » Medinikatha Journal » Arnab Mitra » The house of writer Ramapad Chowdhury in Kharagpur
কথা সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী তাঁর শেষ বয়সে লেখা আত্মজীবনী ‘ফেলে আসা জীবন’-এর কথমুখ অংশে লিখেছেন ‘আমরা যখন মাটির প্রতি আকর্ষণের কথা বলি তখন বোধ হয় বুঝতে পারি না যে আকর্ষণ মাটির নয়, মাটির কাছাকাছি মানুষগুলোর। সেই মানুষগুলি না থাকলে মাটিরও কোনো আকর্ষণ থাকে না’। এই কথাটির মধ্যে দিয়ে তিনি ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন তাঁর জীবনের প্রায় প্রথম কুড়িটি বছর বা কিশোর বয়স অবধি সময় যে রেলশহরে কেটেছিল সেই রেলশহরের মাটি ও মানুষের দিকে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এই রেলশহরটির নাম খড়গপুর।
খড়গপুরে গোলবাজার দুর্গামন্দির -এর কাছে অবস্থিত রমাপদ চৌধুরী-র বাড়ির সামনের অংশ
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বন-জঙ্গলে ঘেরা পাথুরে জমিতে এখানে ইংরেজরা একটি রেল-স্টেশন স্থাপন করেন বেঙ্গল-নাগপুর রেলের সংযোগকারী স্টেশন হিসেবে। সেই সময় কাঁসাই নদীর ধারে জঙ্গলে ঘেরা এই লাল মাটির ওপর ছিল একটি প্রাচীন মন্দির ও কয়েকটি আদিবাসীদের গ্রাম। রেলের কাজের জন্য ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করতে শুরু করল।ভারতের বিভিন্ন অঞ্ছলের ও বিভিন্ন ভাষার লোকেরা এখানে এল।
এই নির্মীয়মাণ ও বাড়তে থাকা রেলশহরে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯২২ সালে। তাঁর কিশোরবয়স অবধি ছোটবেলা কেটেছিল এই রেলশহরে । তারপর তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্বের পড়াশুনার জন্য কলকাতা গেছিলেন। এরপর গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর সাহিত্য-জীবন শুরু হয় কলকাতাতেই । একে একে তিনি লেখেন ‘খারিজ’, ‘এই পৃথিবী পান্থনিবাস’ ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ‘বাড়ি বদলে যায়’-এর মত মধ্যবিত্ত জীবনের কাহিনিগুলি। তবে লেখক হিসেবে তাঁর প্রথম উপন্যাস হল ‘প্রথম প্রহর’।
‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাস ও শেষবয়সে লেখা আত্মজীবনী ‘ফেলে আসা জীবন’ ও ‘হারানো খাতা’-য় তাঁর খড়গপুরে কাটানো সময়ের কথা বেশি ধরা পড়েছে।
‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাসটির শুরুতেই ভূমিকা-পর্বে দেখা যায় ট্রেনের কামরায় একজন বিবাহিত মহিলার সাথে লেখকের দেখা হয়। সেই মহিলা লেখককে খড়গপুর শহরে লেখকের কাটানো ছেলেবেলার কথা মনে করান। একে একে সেইসব মানুষদের কথা বলেন যাদের লেখকও চিনতেন। সেই মহিলা বলেন ‘সদাশিব জ্যাঠা সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেছেন শুনেছ!’। লেখক সেই কথা শুনে উপন্যাসে লেখেন মহিলার সদাশিব জ্যাঠার কথা বলাতে ‘ভোরবেলায় তার তুলসীদাস আবৃত্তি যেন কানের কাছে ভেসে এলো’। এই সদাশিব জ্যাঠার ভোরবেলায় আবৃত্তি আসলে গোলবাজারের দুর্গামন্দির থেকে ভেসে আসত । কারণ লেখকের বাবা রেলের চাকরিসূত্রে যে বাংলোটি পেয়েছিলেন সেটি গোলবাজারের দুর্গামন্দিরের সামনে ডানদিকে অবস্থি্ত। তাই ভোরবেলায় সদাশিব জ্যাঠার তুলসীদাস আবৃত্তি লেখক ছোটবেলায় শুনতেন তাদের দোতলা রেলের বাংলো থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি আত্মজীবনী ‘ফেলে আসা জীবন’-এ লেখেন ‘সেই রেলশহরে আমাদের বাংলোর তিন মিনিটের দূরত্বে ছিল বাঙ্গালিদের দুর্গামন্দির।এই নির্জন মন্দিরের মধ্যে কী আকর্ষণ ছিল জানি না,হয়তো নির্জনতাই, যে কারণে গ্রীষ্ম-দুপুরের অসহ্য গরমেও প্রায়ই চলে যেতাম ওখানে’।
১
রামাপদ চৌধুরীর পিতামহের নাম ছিল ক্ষেত্রনাথ চৌধুরী।তাঁর পরিবার বর্ধমান থেকে খড়গপুরে আসে। রামাপদ চৌধুরী-র বাবা খড়গপুর শহরে রেলওয়ের চাকরিতে একটি বড় পদে ছিলেন। তিনি রেলের চাকরিসূত্রে যে বাংলোটি পেয়েছিলেন সেটি গোলবাজারের কাছে দুর্গামন্দিরের সামনে অবস্থিত।এ প্রসঙ্গে তিনি আত্মজীবনী-তে লেখেন ‘শৈশবজীবনে স্মৃতিতে মার পূজারিণী মূর্তটিই ভেসে ওঠে।সেই রেলশহরে আমাদের বাংলোর তিন মিনিটের দূরত্বে ছিল বাঙ্গালিদের দুর্গামন্দির। এরপর তিনি লিখেছেন ছেলেবেলার স্মৃতিতে দেখি ভোরবেলায় বাবা মালিকে নিয়ে উদ্যানচর্চা করছেন। ‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাসেও বালক তিমু-র বাড়ি বা রেলওয়ে বাংলোর যেরকম অবস্থান ও বর্ণনা রমাপদ চৌধুরী দিয়েছেন,বাস্তবেও ঠিক সেরকমটাই দেখা যায়। এই রেল-কোয়ার্টারটির ঠিক বাঁদিকে বাঙ্গালিদের দুর্গামন্দির ও ডানদিকে হিন্দুদের রামমন্দিরটি অবস্থিত।
খড়গপুরে গোলবাজার দুর্গামন্দির -এর কাছে অবস্থিত রমাপদ চৌধুরী-র বাড়ির সামনের অংশ
রমাপদ চৌধুরীর বাবা করতেন রেলের ‘অডিটরের’ চাকরি। রেলের মালপত্রর কেনাকাটা, শ্রমিকদের মাইনে পত্তরের হিসেব রাখার কাজ করতে হত তাঁকে। রেলওয়ের চাকরিসূত্রে পেয়েছিলেন এই বাংলোটি। এ প্রসঙ্গে তিনি আত্মজীবনী ‘ফেলে আসা জীবন’-এ লিখেছেন ‘বাবার পদমর্যাদা এবং ওই বিশাল বাগান ঘেরা একমাত্র দ্বিতল বাংলোর সুবাদে সকলেই আমাদের রীতিমতো সমীহ করত’।
তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘হারানো খাতায়’য় লিখেছেন ‘আমরা ভারতীয়দের জন্য নির্দিষ্ট উত্তরাংশে অর্থাৎ গোলবাজারের দিকে থাকতাম। উত্তরের এই অংশে, কী কারণে জানি না, বাগানঘেরা একটিই দোতলা বাংলো ছিল এবং সেখানেই আমার জন্ম এবং স্কুলজীবন কেটেছিল। এই বাংলোর দেওয়ালে নম্বর লেখা ছিল সেভেন্টি সিক্স সেভেন্টি সিক্স। তার নিচে একটি রুল এবং রুলের নীচে ওয়ান অর্থাৎ সেভেন্টি সিক্স সেভেন্টি সিক্স ডিভাইডেড বাই ওয়ান’।
আমাদের বাংলোর সামনে দিয়ে গেছে এদিকের প্রধান রাস্তাটি।তারও ওপারে পাঁচিলঘেরা অনেকটা ‘জায়গা নিয়ে হিন্দুস্থানীদের রামমন্দির,যার এক পাশে ছিল তাদের আঁখড়া, সকাল-সন্ধে সেখানে হিন্দুস্থানীরা পালোয়ান হওয়ার জন্য কুস্তি লড়ত। উত্তরে যেমন রামমন্দির,তেমনই দক্ষিণেও ছিল অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাঁচিলঘেরা দুর্গামন্দির।
২
তিনি তাঁদের বাংলোর বিবরণ দিয়ে ‘হারানো খাতায়’য় লিখেছেন ‘আমাদের বাংলোটা ছিল দোতলা,বড় বড় ঘর, কাঠের সিঁড়ি। চতুস্পার্শে ফুলের বাগান, যার তদারকির জন্য রেল থেকেই ‘একজন মালি দেওয়া হত।বাংলোর দু’খানি ঘর বেশ বড়,একটি ছোট আর তার সামনের দিকে যেমন জাফরি ঘেরা করিডর ঘেরা চওড়া বারান্দা ছিল তেমনই পিছনের দিকেও। পিছনে সিমেন্ট-বাঁধানো উঠোন, দুপাশে একদিকে রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, অন্যদিকে স্নানের ঘর,টয়লেট।কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে বিশাল একখানা হলঘর,বারান্দা। কিন্তু নীচে-ওপরে সব জানলাই কাচের। আমি নীচের ঘরটিতে শুতাম একা-একাই, ভোর রাতে উঠে আলো জ্বেলে পড়তে বসলে যাতে অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। শুক্লপক্ষে পুবদিকের এই ঘরটি এবং আমার খাট-বিছানা জ্যোস্নায় ভেসে যেত।বাংলোর চারপাশে ছিল ফুলের বাগান, পশ্চিমে ও দক্ষিণে কয়েকটি কাঁঠাল,জাম এবং নিমগাছ ছিল’।
খড়গপুরে গোলবাজার দুর্গামন্দির -এর কাছে অবস্থিত রমাপদ চৌধুরী-র বাড়ির পিছনের অংশ
এ প্রসঙ্গে আত্মজীবনী ‘ফেলে আসা জীবন’-এ তিনি লিখেছেন ‘আমাদের দ্বিতল বাংলোটি বাইরে থেকে দেখলে খুব সুন্দর মনে হত। চারপাশে বেশ বড়ো বাগান,কাঁটা তারে ঘেরা, লোহার ফটক। বাগানে ফুলের শোভাও ছিল,তার তদারকির জন্যে মালিও ছিল, কিন্তু তার চেয়ে শোভাবর্ধক ছিল কাঁটাতারের ধারে ধারে নিম ও শিরীষ গাছ। শিউলি আর কনকচাঁপা ছাড়া দুটি কাঁঠাল গাছও ছিল। আসলে গাছগুলি ছিল ছায়া বিতরণের জন্য। বাংলোকে এবং বাংলোর চারপাশকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য। কারণ গ্রীষ্মের সেই দাবদাহ ছিল অসহনীয়।ঘরের মধ্যেও।ঘরগুলি মাপে বিশাল, বড়ো বড়ো কাচের জানলাও ছিল।কিন্তু তা সবসময় বন্ধ রাখতে হত, আগুনে হলকা প্রতিরোধের জন্যে। দেখতেই সুন্দর ছিল, বসবাসের জন্যে নয়। দোতলায় ওঠার প্রশস্ত সিঁড়িটি ছিল কাঠের। গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়ি থেকে বেরোনো যদি কখনও নিষিদ্ধ হত মার ধমকে,আমরা ক-ভাইবোন দুদ্দাড় ওই কাঠের সিঁড়িতে ওঠানামা করে মায়ের দিবানিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতাম’।
রমাপদ চৌধুরী পড়াশুনা করেছেন রেলওয়ে বয়েজ স্কুলে যা সেই সময় ‘ইন্ডিয়ান স্কুল’ নামে পরিচিত ছিল। এই স্কুলটিও তাঁদের বাংলোর কাছেই গোলবাজারের ডান দিকে অবস্থিত। তিনি রেলওয়ে স্কুল থেকে মাধ্যমিক বা ইন্টার-মিডিয়েট পাশ করার পর ১৯৩৯ সালে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। চলে আসেন কলকাতায়। তাঁর জন্ম ১৯২২ সালে দুর্গামন্দিরের সামনের এই বাংলোটিতেই । কলকাতা যাওয়ার আগে কিশোর বয়সের শেষ পর্যায় অবধি প্রায় ১৭ বছর কাটিয়েছেন এই রেলওয়ে বাংলোটিতে।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 04.07.2025)
তথ্যসূত্র -
রমাপদ চৌধুরীর লেখা ‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাস
আত্মজীবনী ‘ফেলে আসা জীবন’ ও ‘হারানো খাতা’
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।